সরকারি আয়ের ধারণা| Concept of Government Revenue

সরকারি আয়ের সংজ্ঞা


সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করে থাকে। এক্ষেত্রে সরকার দেশের জনগনের উপর কর ধার্য করে এবং অন্যান্য উপায়ে যে অর্থ সংগ্রহ করে তাকে সরকারি আয় বলে। ব্যক্তি যেমন তার কতগুলো প্রচলিত ও অপ্রচলিত উৎস  হতে আয় সংগ্রহ করে সরকারও তার উৎসসমহ হতে আয় সংগ্রহ তথা অর্জন করে। ব্যক্তির আয়ের সাথে সরকারের আয়ের পার্থক্য অনেক। সরকার তার ব্যয় নির্ধারণ করে আয় উপর্জনের প্রয়াস চালায়। সরকারি আয়ের উৎস সমহ: সরকারি আয়ের উৎস সমহকে দই ভাগে ভাগ করা যায়-

১. কর হতে আয়
২. কর বহির্ভত আয়

সরকার জনগনের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপের মাধ্যমে যে রাজস্ব সংগ্রহ করে তাকে কর হতে আয় বলে। অপরদিকে কর ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত আদায় ও অর্থ হতে যে আয় হয় তাকে কর বহির্ভত আয় বলে। প্রথমে কর হতে আয় বা কর আয় সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। তার পর্বে কর কি তা বঝা জরুরি একটি দেশের জনগন সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন প্রকার সবিধা প্রত্যাশা ব্যতীত সরকারকে বাধ্যতামলকভাবে যে অর্থ প্রদান করে তাকে কর বলে।

সরকারী রাজস্বের বৃহত্তম অংশ কর হতে গহীত। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বৈদেশিক সম্পদের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সরকারি আয়ের উৎস হিসেবে করের গুরুত্ব অনেক বদ্ধি পেয়েছে। দেশের উন্নয়ন তথা বিনিয়োগ বদ্ধির জন্য সরকারি আয় বদ্ধির কোন বিকল্প নাই। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেটে কর হতে আয় ছিল ১৫৫৪০০ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেটে কর হতে আয় ছিল ২১০৪০২ কোটি টাকা।

সরকারের কর হতে আয়ের মধ্যে আয়কর, মনাফা কর, মল্য সংযোজন কর, আমদানী রপ্তানী শল্ক, সম্পরক শুল্ক, আবগারী শুল্ক, স্ট্যাম্প, ভমি রেজিস্ট্রেশন, পরিবহন কর ইত্যাদি অন্তর্ভক্ত। এবার কর বহির্ভত আয় গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। কর ছাড়া সরকার যেসব উৎস হতে আয় বা রাজস্ব সংগ্রহ করে তাকে কর বহির্ভত আয় বলে। এ উৎস যেসব খাতকে অন্তর্ভক্ত করে সেগুলো হলো ডিভিডেন্ড ও মনাফা, সদ, প্রশাসনিক আয়কর ও ফি, জরিমানা, বানিজ্যিক আয়, সরকারি সম্পত্তি থেকে আয়, জরুরী অবস্থায় সরকারি ঋণ, প্রতিরক্ষা খাত হতে আয় ইত্যাদি। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেটে কর বহির্ভত আয় ছিল ২২০০০ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেটে এ উৎস হতে আয় হয় ৩২৩৫০ কোটি টাকা।

নিম্নে সরকারি আয়ের কর বহির্ভত আয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. মনাফা ও লভ্যাংশ: সরকারি শিল্প কারখানার তথা কোম্পানী সমহের মনাফা ও লভ্যাংশ থেকে সরকারের প্রচর আয় হয়ে থাকে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ উৎস হতে ৭৯২২ কোটি টাকা অর্জিত হয়।

২. সুদ: সরকার অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংগঠন ইত্যাদিকে ঋণ প্রদান করে থাকে। এসব ঋণের সদ থেকে আয় হয়। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ উৎস হতে ৮০০ কোটি টাকা আয় অর্জিত হয়।

৩. ফি: কোন ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ কোন সবিধা প্রদানের বিনিময়ে তার নিকট থেকে যে অর্থ সরকার আদায় করে তাই ফি। যেমন: কোট ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি ইত্যাদি। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ উৎস হতে ৪৮৩৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়।

৪. জরিমানা: সরকার আইন শঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কাছ থেকে শাস্তিস্বরূপ বা ক্ষতিপরণ বাবদ যে অর্থ আদায় করে তাই জরিমানা। জরিমানা করের মতোই বাধ্যতামলক। তবে কেবল অপরাধির ক্ষেত্রেই বাধ্যতামলক। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ উৎস হতে ৩৫৬ কোটি টাকা আদায় হয়।

৫. সরকারি সম্পত্তি: দেশের বিভিন্ন জায়গা প্রচর সরকারি সম্পত্তি রয়েছে যেমন-খাল, বিল, নদী, বন , সরকারি খাস জমি ইত্যাদি লীজ দিয়ে সরকার প্রচর অর্থ উপার্জন করে থাকে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ উৎস হতে সরকার ১২৯ কোটি টাকা আয় করে।

৬. টোল ও লেভী: সরকার নির্মিত বিভিন্ন সেত ও নির্মাণ হতে টোল আদায় করে থাকে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে লেভী আরোপ করে থাকে। এ উৎস হতে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সরকার ৭৫৮ কোটি টাকা আয় করে।

৭. বাণিজ্যিক আয়: সরকারি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন- রেল বিভাগ, ডাক ও তার বিভাগ ইত্যাদি উৎস হতে যে আয় হয় তাই বাণিজ্যিক আয়।

৮. বিশেষ কর: কোন এলাকায় উন্নয়নমলক কাজ যেমন- রাস্তাঘাট, বিদ্যৎ, গ্যাস তথা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে ঐ এলাকার জমির দাম ছেড়ে যায়। এটি ঐ এলাকার অনপর্জিত আয়। এ আয় বদ্ধিতে এলাকার জনগনের কোন অবদান নেই। এক্ষেত্রে যেসব লোক বা প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে লাভবান হয় তাদের উপর সরকার বিশেষ কর আরোপের মাধ্যমে আয় উপার্জন করে।

৯. বিবিধ: সরকার অনেক সময় ক্ষতিপরণ, পরস্কার এবং বৈদেশিক সাহায্য হতে অনেক আয় করে।


সরকারি আয়ের প্রয়োজনীয়তা


বর্তমান বিশ্বে সেই সরকারই ভাল যে বেশী ব্যয় করে। পর্বে ধারণা ছিল উল্টো। কাজেই আয় না হলে ব্যয় সম্ভব নয়।বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত: ঘাটতি বাজেট করে থাকে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী হলে বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। তবে প্রত্যেকটি দেশে সষম বাজেট কাম্য। আর তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি রাজস্ব প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে। সরকারি আয়ের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা যাক-

ক) ভর্তকী ও বিশেষ বরাদ্দ: বর্তমানে সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ভর্তকী প্রদান করে থাকে। কখনো কখনো বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। অনন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোর জন্য এ ভর্তকী ও বরাদ্দ অত্যন্ত জরুরি। এটি সম্ভব কেবলমাত্র সরকারি আয় বদ্ধির মাধ্যমে।

খ) ক্ষতিকর দ্রব্যের উৎপাদন নিরুৎসাহিতকরণ: সরকার বিভিন্ন ক্ষতিকারক পণ্য যেমন সিগারেট, অপিয়াম, এলকোহল ইত্যাদি তৈরীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রার কর আরোপ করে। এর ফলে একদিকে সরকার অধিক হারে রাজস্ব আদায় করে অন্যদিকে ক্ষতিকারক পণ্য উৎপাদনও রোধ করে।

গ) শিশু শিল্প সংরক্ষণ: সরকার দেশের ক্ষদ্র ও কটির শিল্প এবং উঠতি বিভিন্ন শিল্পকে বিদেশী প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমদানী শুল্ক আরোপ করে থাকে। এতে একদিকে রাজস্ব বদ্ধি পায় অন্য দিকে শিশু শিল্প বিকশিত হওয়ার সযোগ সষ্টি করে।

ঘ) পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন: সরকার বিভিন্ন উৎস হতে যে আয় করে তার মধ্যে কতগুলো উৎস আছে যেগুলো থেকে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে। নিশ্চিত প্রাপ্তব্য রাজস্ব থাকলে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সষ্ঠভাবে করা যায়। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পিত হয়।

ঙ) অর্থনৈতিক অসমতা হ্রাস: পুজিবাদী দেশে এবং মিশ্র অর্থনীতির দেশের অনেক ক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব আদায়ের ফলে অর্থনৈতিক অসমতা তথা আয়ের বৈষম্য হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে সরকার ধনী শ্রেনীর উপর অধিক হারে কর আরোপ করে সমাজের গরীব জনগনের জন্য ব্যয় করতে পারে। যেমন-গরীবদেরকে রাজস্ব খাদ্য সরবরাহ, কম টাকায় বাসস্থান, ফ্রি মেডিকেল সহায়তা ইত্যাদি প্রদান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url