বাজার অর্থনীতির কার্যাবলি|Function of Market Economy

বাজার অর্থনীতিতে যেহেতু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ মুক্ত সেহেতু উৎপাদন ও ভোক্তা উভয়ই স্বাধীন। অর্থনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে উৎপাদন, ভোগ ও বণ্টন স্বাধীনভাবে উৎপাদনও ভোগ করে থাকে। নিচের বাজার অর্থনীতির কিছু উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১. মূল্যনির্ধারণ: বাজারে প্রথমে উৎপাদন ও সেবার দাম স্থির করা হয়। বাজারে চাহিদা ও যোাগনের ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বাজারে নির্ধারিত মূল্য হয় স্থিতিশীল।

২. উৎপাদন নির্ধারণ: বাজার অর্থনীতি দ্রব্যের উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বাজারে চাহিদার উপর ভিত্তি করে উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদন বা ঘাটতি স্তরের উৎপাদন নির্ধারণ হয় না।

৩. দ্রব্য ও উপকরণ বণ্টন: বাজারে যেসব দ্রব্যের চাহিদা বেশি থাকে তার বণ্টন দ্রুত হয় আবার যেসব দ্রব্যের চাহিদা বেশি সে সব দ্রব্যের মূল্য বেশি বৃদ্ধি পায়। বাজার অর্থনীতি এজন্য উপকরণ এবং চাহিদা দ্রব্যাদির চাহিদা অনুসারে বণ্টন হয়।

৪. তথ্য প্রদান: বাজার অর্থনীতিতে বাজার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে থাকে। ফলে উৎপাদকরা বাজার সম্পর্কে ভবিষ্যৎ চাহিদা ও মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি ধারণা করতে পারে। আবার, পণ্য উৎপাদনের উৎস এবং প্রাপ্যতার তথ্য ভোক্তা বাজার থেকে পেয়ে থাকে।

৫. মৌলিক সমস্যার সমাধান: বাজার অর্থনীতিতে অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ কাম্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়। সাথে সাথে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে থাকে। এজন্য বাজার অর্থনীতির দ্বারা মৌলিক সমস্যার দ্রুত সমাধান করা সহজ হয়।

৬. রেশনিং প্রদান অনুসরণ: মূল্যবৃদ্ধির সময় পণ্য ভোগের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের রেশনিং পদ্ধতির মাধ্যমে বাজার অর্থনীতি উৎসাহিত করতে পারে।

৭. দ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণ: ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য সর্বপরি বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকায় উৎপাদকরা দ্রব্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

৮. স্বাধীনতা প্রদান: বাজার অর্থনীতিতে উৎপাদকরা দ্রব্যের উৎপাদনে স্বাধীনতার যেমন পেয়ে থাকে তেমনি ভোক্তারা পণ্য ভোগের স্বাধীনতা তেমনিভাবে পেয়ে থাকে। এজন্য উৎপাদন, ভোগ ও বণ্টন জনগণ স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারে। সুতরাং দেখা গেল যে, বাজার অর্থনীতিতে কার্যাবলি ব্যাপক তবে এদের মধ্যে কোনটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে সেটা বলা খুবই কঠিন। তারপর ও সফলতার সাথে রাজার অর্থনীতি তার কার্যাবলিকে পরিচালনা করে থাকে।

বাজার অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা|Role of Government in Market Economy


বাজার অর্থনীতিতে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা ও ভোগ স্বীকৃত এজন্য সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। সমাজে আয় বৈষম্য, শোষণ, অসম বণ্টন অধিক মাত্রায় দেখা দেয়। আর এসব কারণে আংশিকভাবে হলেও রাষ্ট্রের ভূমিকা এসে যায়। নিচে বাজার অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আলোচনা করা হলো:

১. প্রতিরক্ষা: বাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত থাকায় জনগণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।

২. আইন শৃঙ্খলা রক্ষা: দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নের স্বার্থে একান্তভাবে কাম্য। এজন্য দেশে আইন শৃঙ্খলার রক্ষা করা সরকারের নৈতিকতা দায়িত্ব।

৩. গণদ্রব্য: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, রাস্তাঘাট, পার্ক ইত্যাদি বাজার অর্থনীতিতে কোন ও ভোগ সম্ভব নয়। এগুলো উৎপাদন ও মেরামত সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৪. আর্থসামাজিক অবকাঠামো: মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দক্ষ জনশক্তিই পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে। সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. সামাজিক নিরাপত্তা: বাজার অর্থনীতিতে উদ্যোক্তারা সাধারণত মুনাফা উদ্দেশ্য কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। তারা সমাজের পঙ্গু, অবহেলিত, কাজে অক্ষম ব্যক্তিদের কল্যাণে এগিয়ে আসতে চায় না। সরকারকেই এসব ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে থাকে।

৬. অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নত: অর্থনৈতিক অবকাঠামো ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রগতি অর্জনের সম্ভব হয় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন একান্তভাবে কাম্য। বাজার অর্থনীতিতে অবকাঠামোর উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য সরকার যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে।

৭. একচেটিয়া প্রভাব বিলোপ: বাজার অর্থনীতি চালু থাকায় অর্থনীতিতে একচেটিয়া শক্তির উদ্ভব হয়। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করে থাকে। সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে একচেটিয়া প্রভাব বিলোপ সাধন হয়ে থাকে।

৮. সম্পদের সুষম বণ্টন: বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু থাকায় সম্পদের অসম বণ্টন হয়ে থাকে। ফলে ধনীরা আরো ধনী এবং গরিবরা আরো গরিব হয়ে পড়ে। সরকার হস্তক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, বাজার অর্থনীতিতে সরকারি খাত ব্যক্তিগত খাতের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাজার অর্থনীতি সমাজের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে সরকারের ভূমিকা একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে সাহায্য করে।

বাজার অর্থনীতি প্রবর্তনের জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ|Some Measures to Overcome Market Economy by Government


স্বাধীনতার পর সরকার বাজার অর্থনীতি চালু করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কারণ বাজার অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত একটি বিষয়। স্বাধীনতার পর এদেশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল মিল কলকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয় এবং পাশাপাশি ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে সীমাবদ্ধতা গণ্ডির মধ্যে বেধে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যক্তি বিনিয়োগ কে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং আজও তার ধারা অব্যাহত আছে। নিচের সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ অব্যাহত আলোচনা করা হলো:

১. বিরাষ্ট্রীয়করণ: রাষ্ট্রীয় কলকারখানাসমূহ বিরাষ্ট্রীয়করণের জন্য সরকার বেসরকারি বিনিয়োগ বোর্ড গঠন করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্প কলকারখানাসমূহ বিরাষ্ট্রীকরণ করা হয়েছে।

২. ব্যক্তিগত বিনিয়োগ: স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে শিল্প ক্ষেত্রে ২৫ লক্ষ টাকার বেশি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয় ফলে পরবর্তীতে ব্যক্তি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ১৯৭৮ সালের শিল্পনীতিতে প্রথমবারের মতো ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগ সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়া হয়। ১৯৮২ সালে শুধু মৌলিক ও ভারী শিল্প ছাড়া ব্যক্তি খাততে অধিকতর সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।

৩. উদার বাণিজ্য নীতি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি রপ্তানি বৃদ্ধি তথা বাণিজ্য সম্প্রসারণে জন্য শুল্ক হার হ্রাস এবং কোটা পদ্ধতি শিথিল করে। ফলে সরকার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে উদার বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করে।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার: দেশে বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসায়ী গ্রুপ যাতে অবাধ ব্যাংক ও বীমা স্থাপন করতে পারেন সেজন্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রয়ত্ব উত্তরা, পূর্বালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবার পাশাপাশি আরো বেসরকারি ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

৫. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার: বৈদিশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রত্যাহার করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে চাহিদা ও যোগান এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

৬. সংরক্ষণমূলক খাতে দেশী বিদেশি উদ্যোক্তা: ১৯৯৯ সালের শিল্পনীতি মাত্র চারটি অর্থনৈতিক খাততে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রাখা হয়। পরবর্তীতে তাও প্রত্যাহার করে দেশী বিদেশি উদ্যোক্তার বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হয়।

৭. রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল স্থাপন: দেশী বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল নামে শুল্ক মুক্ত ও বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত গড়ে তোলেন। মূলত সরকার বাজার অর্থনীতিতে প্রবর্তনের জন্য E.P.Z. তৈরি করেন যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

সুতরাং দেখা গেল যে, বাজার অর্থনীতি প্রবর্তনের জন্য সরকারি উপযুক্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

বাজার অর্থনীতির কার্যাবলি
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url