বাজার অর্থনীতি | Market Economy
বাজার অর্থনীতি কী? What is Market Economy?
ক্রেতা ও উৎপাদকের ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা তথা লাভ - লোকসানের চিন্তা থেকে যে প্রতিযোগিতামূলক ও মুক্ত অর্থব্যবস্থা চালু হয় তাকেই বাজার অর্থনীতি বলে। আবার বলা যায়, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও অবাধ বিনিময় সম্পর্কের উপর যে অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত তাকে বাজার অর্থনীতি বলে।
বাজার অর্থনীতি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতীত বিবেচনাধীন পণ্য অথবা উপকরণের চাহিদা ও যোগান দ্বারা এদের মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এর ভিত্তিতে পণ্য বা উপকরণের ক্রয় - বিক্রয় সম্পাদন হয়। এক্ষেত্রে বাস্তবে সরকারি হস্তপেক্ষ থাকলেও তা ন্যূনতম এবং পরোক্ষ ধরনের হতে পারে।
বাস্তবে বিশুদ্ধ অর্থে মুক্তবাজার বা মুক্ত অর্থনীতি নেই। কারণ বর্তমান যুগে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজার প্রক্রিয়ার উপর শতকরা ১০০ ভাগ কোন দেশের সরকার নির্ভর করতে পারে না। এজন্য মুক্তবাজার বারণা আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহার করা উচিত।
বাজার অর্থনীতির ক্রমবিকাশ|Evolution of Market Economy
অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মীথ ১৭৭৬ সালে তাঁর সাড়া জাগানো বিখ্যাত গ্রন্থ “An Enquiry into the nature vand the cause of the wealth of Nations” প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে সর্বপ্রথম তিনি বাজার অর্থনীতির ধারণা দেন। বাজার অর্থনীতিতে তিনি সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত হিসেবে ধরে নেন। তাঁর মতে বাজারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আয়, উৎপাদন পূর্ণ নিয়োগের অবস্থা নির্ধারিত হবে। পরবর্তীতে তার এই বক্তব্যকে ডেভিড রিকার্ডো, জে. এস. মিলসহ অনেক ক্লাসক্যাল অর্থনীতিবিদগণ সমর্থন যোগান। ১৯৩০ সালের পূর্বে রাশিয়ার লেলিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯১৭ সালে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সৌভিয়েট ইউনিয়নের জন্ম হয়। ১৯৩০ সালে মহামন্দার পর বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ভাটার সৃষ্টি হয়।
১৯৩৬ সালে লর্ড কেইনস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The General Theory of Employment Interest and Money” সরকারি হস্তক্ষেপ অর্থনীতিতে আর্শিবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ফলশ্রুতিতে অবাধ অর্থনীতির জনপ্রিয়তা মুখ থুবড়ে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীতে GATT বা WTO প্রতিষ্ঠার পর অবাধ অর্থনীতির পথ পরিক্রমার হাত পড়ে। মহামন্দার সংকট নিরসনে লর্ড কেইন্স এর সরকারি হস্তক্ষেপ নীতি অর্থনীতিতে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করতে ধরে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বর্তমানের বাজার অর্থনীতি ক্রমবিকাশ ঘটে।
বাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য|Characteristic of Market Economy
পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও অবাধ বিনিময় সম্পর্কের উপর যে অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত তাকে বাজার অর্থনীতি বলে। সাধারণত বাজার অর্থনীতির যেসব বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ব্যক্তিগত সম্পদ: বাজার ব্যবস্থার অধীনে উৎপাদনের উপাদানসমূহ অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য সম্পদ ব্যক্তিবর্গ এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকে।
২. পছন্দ এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা: পছন্দের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বলতে বুঝায় ব্যক্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সম্পদ, মূলধন এবং অর্থ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারবে। আবার ভোক্তারা তাদের সামর্থ্য এবং ইচ্ছানুযায়ী দ্রব্য ও সেবা ক্রয় করে নিজেদের বিভিন্ন ধরনের অভাব পূরণ করতে পারবে।
৩. নিজ স্বার্থের ভূমিকা: বাজার অর্থনীতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মেনে নেয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের উপর নিজের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। এজন্য দেখা যায় যে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মুনাফা লাভের চেষ্টা করে।
৪. প্রতিযোগিতা: বাজার অর্থনীতির ক্ষেত্রে দরকষাকষি ও পূর্ণ প্রতিযোগিতা দ্বারা যে কোন কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ এবং পছন্দের স্বাধীনতা বাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
৫. মূল্য প্রতিক্রিয়া: ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পছন্দের স্বাধীনতা এবং নিজের স্বার্থ এই বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপায় হচ্ছে মূল্য প্রতিক্রিয়া। ক্রেতার সিদ্ধান্ত চাহিদা এবং বিক্রেতার সিদ্ধান্ত যোগান দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
৬. সরকারের কার্যক্রম: বিশুদ্ধ বাজার অর্থনীতির একমাত্র প্রতিরক্ষা, প্রশাসন, আইন - শৃঙ্খলা এবং এরূপ কতিপ অতি জরুরি কাজে নিয়োজিত থাকে।
৭. মুনাফার ধরন: বাজার অর্থনীতিতে উৎপাদনকারী মুনাফার আশায় উৎপাদন করে। বাজারে বেশি দামে বিত্রি করবে, এটাই বিক্রেতার প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু ক্রেতা কম দামে দ্রব্য ক্রয় করতে চাইবে। এর মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রতার মধ্যে দরকষাকষি হবে। উৎপাদনকারী কখনো তার যোগান মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে দ্রব্য বিক্রি করতে সম্মত হবে না।
৮. উৎপাদন ও মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ: কেবলমাত্র বাজার অর্থনীতিই উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতা দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ভালো দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে। বাজার মূল্যস্তরকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।
৯. দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা: বাজার অর্থনীতি সকল মালিকানা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও প্রতিযোগী করে তুলতে পারে।
১০. প্রতিযোগিতা ও সমন্বয়: বাজার অর্থনীতি ব্যক্তিমালিকানা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সমন্বয় করতে পারে।
১১. স্বয়ংক্রিয় কার্যধারা: বাজার অর্থনীতি নিজস্ব গতিতে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে এবং ব্যক্তি তার নিজ স্বার্থকে সংযুক্ত করে বাজার কার্যক্রমকে বেগবান করতে সহায়তা করে। উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বাজার অর্থনীতি হচ্ছে একটি আদর্শ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ অর্জিত হতে পারে। এতে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশেষায়ণ সম্ভব হয় মুনাফার তাড়নায় এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে উন্নত কৌশলের উদ্ভাবন ঘটে।