এনজিও এর প্রকারভেদ
বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে বহু ধরনের বেসরকারি সংস্থা সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এসব বেসরকারি সংস্থা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রকৃতি, পরিধি, আর্থিক উৎস প্রভৃতি বিবেচনায় এদেশে ৫ ধরনের বেসরকারি সংস্থা কর্মরত রয়েছে। এগুলো নিচে আলোচনা করা হলো—
১. স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা (Local NGO): একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় অল্প পরিসরে স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ সংস্থাগুলো কাজ করে, যেমন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সচেতনতা তৈরি প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। এদের মধ্যে রয়েছে মেহের পঞ্চগ্রাম সমবায় সমিতি, টিটিএমএস, ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার, স্থানীয় এতিমখানা প্রভৃতি।
২. আঞ্চলিক বেসরকারি সংস্থা (Regional NGO): এগুলো হলো অঞ্চলভিত্তিক গড়ে ওঠা বেসরকারি সংস্থা। রংপুর, দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস (RDRS) এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৩. জাতীয় বেসরকারি সংস্থা (National NGO): গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, কারিতাস, আশা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৪. আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (International NGO): এসব বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কর্মরত বিদেশি অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় এবং ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সংস্থাগুলো এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত; যেমন— কেয়ার বাংলাদেশ, এসওএস, সেভ দ্য চিলড্রেন, কাসান, ওয়াল্ড ভিশন, টেরেডেস হোমস ইত্যাদি।
৫. আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (International Associate NGO): জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচালিত বেসরকারি সংস্থানসমূহের আর্থিক, কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ এবং সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের কাজ হলো উল্লিখিত সংস্থার অনুকূলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। ফোর্ড ফাউন্ডেশন, এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইউএসএইড, অক্সফাম, ইউকেএইড, ডানিডা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, ইউএনডিপি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে এনজিও - এর ভূমিকা Role of NGO in Bangladesh
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বসীমা ২১.৮% , আর দারিদ্র্যের নিম্ন সীমা ১১.৩%। এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্র্যাক, কেয়ার, হিড, প্রশিকা, আশা, শক্তি ফাউন্ডেশন, টিএমএসএস, সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস (এসএসএস), স্বনির্ভর বাংলাদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে NGO- এর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম| Function of Microcredit of NGO in Bangladesh
ক্ষুদ্রঋণ খাতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশেষায়িত কর্মসূচি, সরকারি - বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্য, কার্যক্রমের গুণগত মান ও এ সেক্টরের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন -২০০৬ পাস হয় এবং কার্যকর করা হয় ২৭ শে আগস্ট ২০১৬ থেকে। এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। এ আইন অনুযায়ী, এর সনদ ব্যতিরেকে কোনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। এমআরএ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৮১১ টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে সনদ প্রদান করেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের ঋণদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ২,৫৬৮ টি শাখার মাধ্যমে ৬৪ টি জেলার ৪৭৯ টি উপজেলার ৮১,৬৭৮ টি গ্রামে ৯১.৩২ লক্ষ সদস্যের মধ্যে এ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে এর মধ্যে ৯৭ শতাংশই মহিলা। ব্যাংকটি ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৯৪৪৯০.৯০ কোটি টাকা এবং আদায়কৃত ঋণের পরিমাণ ১,৭৮,৯২০.৯৭ কোটি টাকা।
NGO কার্যক্রমের পটভূমি| Background of NGO activities
স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, হাট - বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অবকাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে এক বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কারণ উল্লিখিত ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় বিধায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেবামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। NGO গুলো আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে NGO গুলোর ভূমিকা ছিল যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া এবং এদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। তবে সময়ের বিবর্তনে এদের কার্যক্রমের পরিধি অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। কৃষি, কুটির শিল্প, ঋণদান ও সঞ্চয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃমঙ্গল ও শিশু পরিচর্যা, স্যানিটেশন, সামাজিক বনায়ন ছাড়াও আরও অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে NGO নিজেদের সম্পৃক্ত করে, এছাড়াও অনেক NGO ছিন্নমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েও কাজ করছে। তবে এদের মূল কার্যক্রম গ্রামকেন্দ্রিক, অর্থাৎ গ্রাম উন্নয়নই এদের প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সূচনালগ্নে NGO গুলো বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করে। তবে তাদের বেশির ভাগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় মাঠ পর্যায়ে। অর্থাৎ গ্রামের চাহিদাকে সামনে রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেই কার্যক্রমের সূচনা হয়। অপরপক্ষে, সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শহরের অফিসে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে যা অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এমনকি সরকারের গৃহীত অনেক কার্যক্রম, গ্রামের দরিদ্র জনগণের কাছে পৌছাতে পারে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকাণ্ডে NGO- এর সাফল্যও উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮০ ভাগ। সরকার ও NGO উভয়ের সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে ঐ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২১.৮ শতাংশে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও কমবে বলে আশা করা যায়।