পরিকল্পনার গুরুত্ব | Importance of Planning

পরিকল্পনা হলো ব্যবস্থাপনার প্রথম ও অন্যতম প্রধান কাজ। এর ওপর ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠানের উপায়-উপকরণ ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই নয় বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কথা কল্পনা করা যায় না। এর গুরুত্ব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

১. উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা (Helps to achieve objective): প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ পরিচালনা করে। পরিকল্পনার প্রধান কাজ হলো প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করা। এটি বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়ের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য অর্জন হয়। তাই, পরিকল্পনাকে উদ্দেশ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার বলা হয়।

২. অনিশ্চয়তা দূরীকরণ (Removing uncertainity): প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কাজ করতে হয়। ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, সে সম্পর্কে পরিকল্পনার মাধ্যমে ধারণা পাওয়া যায়। এভাবে পরিকল্পনা পরিবর্তনশীল ব্যবসায় পরিবেশের অনিশ্চয়তা দূর করে স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও ধারাবাহিক উন্নয়নে সহায়তা করে।

৩. উৎপাদনের উপকরণের যথাযথ ব্যবহার (Proper utilization of the factors of production): ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাফল্য উৎপাদন উপকরণের (ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন) সর্বোত্তম ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ, পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদনের উপকরণ ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বাধিক উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

৪. ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (Development and expansion of business): প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হয়। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ঝুঁকি কমানো এবং অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা হয়। এভাবে পরিকল্পনা ব্যবসায়িক সাফল্য নিশ্চিত করে।

৫. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increasing efficiency): দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল কাজের মাধ্যমে শুধু সমস্যাই বাড়ে। এর মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন কখনও সম্ভব হয় না। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করা হলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রতিটি উপকরণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং কার্যকারিতা বাড়ে।

৬. অপচয় হ্রাস (Minimizing wastage): সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে অতিরিক্ত ব্যয় কমে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুচিন্তিত কাজ করা হলে কাজ সম্পাদনে খরচ অনেক কম হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ে বাজেট তৈরি করে তার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালিত হলে মিতব্যয়িতা অর্জন সহজ হয়। জনশক্তি ও অন্যান্য উপকরণের অপচয় কমাতেও পরিকল্পনা সহায়তা করে থাকে।

৭. অন্যান্য ব্যবস্থাপকীয় কাজের ভিত্তি (Base of other managerial function): পরিকল্পনাকে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এর সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো নির্ধারণ, কাজের দায়িত্ব বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হয়। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ কাজকে সহজ করে দেয়। অর্থাৎ, পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে কি না, তা পরিমাপ এবং কোনো ধরনের ত্রুটি দেখা দিলে তা সংশোধন করা হয়। এভাবে, পরিকল্পনা ব্যবস্থাপকীয় অন্যান্য কাজের ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

৮. সমস্যা সমাধান (Problem solving): বর্তমানে জটিল ব্যবসায় জগতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নকারীরা আগে থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকেন। সমস্যার কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় বলে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলিতে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। বরং, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

৯. ভবিষ্যৎ কাজের রূপরেখা (Outline of future activities): পরিকল্পনাকে প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের নকশা বা রূপরেখা বলা হয়। প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে। ফলে তারা তাদের করণীয় সম্পর্কে আগে থেকেই জানতে পারেন। এতে কর্মীরা মানসিক প্রস্তুতিসহ কাজ করতে পারেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনও সহজ হয়।

১০. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন (Implementing decision): এর মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন বা সম্পর্ক নিশ্চিত করা হয়। ফলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের আওতাভুক্ত কার্যাবলির সমন্বয়সাধন সহজ হয়। এতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।

১১. ভবিষ্যৎ দর্শন (Future foreseeing): পূর্বানুমান ও অতীত কার্যক্রমের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি হয়। এর সাহায্যে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি অনুধাবন করা যায়। ফলে এটি ব্যবস্থাপনার সব পক্ষকে ভবিষ্যৎ দেখতে সহায়তা করে থাকে। এজন্য পরিকল্পনাকে দর্পণ বা আয়নার সাথে তুলনা করা হয়।

১২. ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দূরীকরণ (Removing risk and uncertainty): যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঝুঁকি অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করতে হয়। যেমন: পণ্য পচে যেতে পারে, চাহিদার পরিমাণ কমে যেতে পারে। এসব ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দূর করা বা এড়িয়ে চলা যায়।

১৩. প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন (Organizational development): যেকোনো ধরনের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে গতিশীলতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়। কর্মীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন, উপকরণের সুষ্ঠু ব্যবহার ও কাজের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি প্রয়োগসহ সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

তাই বলা যায়, পরিকল্পনা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সঠিক পরিকল্পনা একটি প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই, পরিকল্পনাকে ব্যবস্থাপনার সার্বিক কাজ পরিচালনা ও বাস্তবায়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url