পরিকল্পনা |Planning
পরিকল্পনার ধারণা | Concept of Planning
ব্যবস্থাপনার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো পরিকল্পনা। কোনো কাজ করতে চাইলে শুরুতে পরিকল্পনা করতে হয়। এই পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ কাজের দিকনির্দেশনা। অর্থাৎ, চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে নির্ধারিত ভবিষ্যৎ কাজের আগাম নকশাকে পরিকল্পনা বলে।
মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজের পেছনে একেকটি উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কী কী কাজ করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কখন এবং কাদের দিয়ে করানো হবে প্রভৃতি বিষয় আগে থেকে নির্ধারণ করা হলো পরিকল্পনা। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজের সবচেয়ে উত্তম উপায় নির্ধারণ করা হয়। এজন্য পরিকল্পনাকে ভবিষ্যতের দর্পণ বলা হয়। তাছাড়া, যেকোনো কাজে সফলতার জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা।
ডব্লিউ. এইচ. নিউম্যান (W. H. Newman) এর মতে,
কী করতে হবে তার অগ্রিম সিদ্ধান্ত নেওয়াই হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন। তাই পরিকল্পনা হলো কাজ সম্পাদনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি।
এল. এ. অ্যালেন (L. A, Allen) এর মতে,
পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎকে ধরার একটি ফাঁদ।
রিকি ডব্লিউ. গ্রিফিন (Ricky W. Griffin) এর মতে,
পরিকল্পনা বলতে একটি সংগঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা অর্জনের সবচেয়ে উত্তম উপায় স্থির করাকে বোঝায়।
ওপরের আলোচনা ও সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিকল্পনা সম্পর্কে নিচের ধারণা পাওয়া যায়-
১. পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক কাজ;
২. এটি লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে;
৩. এটি ভবিষ্যৎ কাজের দিকনির্দেশনা দেয়;
৪. এটি একটি মননশীল ও চিন্তন প্রক্রিয়া;
৫. এটি বিকল্প কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে প্রভৃতি।
অতএব, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কোন কাজ, কে করবে, কীভাবে করবে, কখন করবে, কত সময়ের মধ্যে করা হবে প্রভৃতি নির্ধারণ করাকে পরিকল্পনা প্রণয়ন বলে।
পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Planning
ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের পূর্বনির্ধারিত প্রতিচ্ছবি হলো পরিকল্পনা। এর ওপর ভিত্তি করেই ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ পরিচালিত হয়। পরিকল্পনা সঠিক না হলে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ সফল হয় না। তাই একে ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করা হয়। এর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, যা একে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ থেকে আলাদা করেছে। নিচে এ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য (Specific goal): লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সুনির্দিষ্টতা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পরিকল্পনা প্রণয়নের পেছনে কোনো না কোনো ইতিবাচক ও যুক্তিযুক্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থাকে। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে ও ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।
২. চিন্তাশীল প্রক্রিয়া (Thinking process): ব্যবস্থাপনা পণ্ডিত Alford এর মতে, 'Planning is the thinking process' অর্থাৎ, পরিকল্পনা হলো চিন্তাশীল প্রক্রিয়া। এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত মানসিক কাজ। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কাজের উপায় প্রতিফলিত হয়। তাই ব্যবস্থাপককে চিন্তা-ভাবনা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও কল্পনাশক্তি দিয়ে এটি প্রণয়ন করতে হয়। অর্থাৎ, পরিকল্পনার সাথে মনস্তাত্ত্বিক বিষয় জড়িত।
৩. ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা (Future guideline): পরিকল্পনা সব সময়ই ভবিষ্যতমুখী। প্রয়োজনীয় উপাত্ত, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমানের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। আগামীতে কোন কাজটি করা হবে বা হবে না, তার একটি সুস্পষ্ট নকশা হলো পরিকল্পনা। এজন্য Koontz and O'Donnell পরিকল্পনাকে ভবিষ্যতের দর্পণ (Looking Glass) এর সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কাজ সমাধানের সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।
৪. সৃজনশীল (Creative): প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে পরিকল্পনাকে খাপ খাওয়াতে হয়। এজন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপককে যথেষ্ট সৃজনশীল হতে হয়। সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়ে কাজের নতুন নতুন পদ্ধতি ও উপায় আবিষ্কার করতে হয়।
৫. নির্দিষ্ট সময় (Specific time): পরিকল্পনা নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করা যায়। তাই, পরিকল্পনাকে সফল করতে হলে এর কার্যাবলি সম্পাদনের নির্দিষ্ট সময় থাকা জরুরি। সময় নির্ধারিত না থাকলে কোনো কাজে শৃঙ্খলা থাকে না।
৬. সমন্বয় ও যোগসূত্র (Coordination and linkage): পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও যোগসূত্র রক্ষা করা হয়। ব্যবস্থাপকরা প্রণীত পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় না করলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব। হয় না। এতে প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা এবং অনেক সমস্যা দেখা দেয়।
৭. নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি (Base of control): পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, তা যাচাই করাই নিয়ন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য। এজন্য পরিকল্পনাকে নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি বলা হয়। অর্থাৎ, পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই নিয়ন্ত্রণ কাজ করা হয়। সম্পাদিত কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী না হলে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তা আবার করা হয়।
সাধারণত উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোই পরিকল্পনায় দেখা যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিকল্পনা একটি স্বতন্ত্র কাজ বলে, বিবেচিত হয়।