বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনার সমস্যা | Problems of Management in Bangladesh
যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উন্নত বিশ্ব আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধি লাভ করছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্র ব্যবস্থার পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হয়। এ লক্ষ্যে বড় ও মাঝারি আয়তনের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। এতে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। আবার, বিশ্বের মুক্তবাজার অর্থনীতি সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে। এজন্য বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রক্রিয়া চলছে। এতেও এগুলোর ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনার প্রধান সমস্যাগুলো হলো-
১. দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব (Lack of efficient manager): বাংলাদেশে দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব আছে। আমাদের দেশে ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি পেশার মর্যাদা দেওয়া হয় না। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে কম। তাই ব্যবস্থাপকদের ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মৌলিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
২. সততা ও দক্ষতার অভাব (Lack of honesty and efficiency): ব্যবস্থাপকদের সাথে কর্মীরা সরাসরি জড়িত থাকে। অধীন কর্মীরা দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান হলে তারা নির্বাহীর নির্দেশ সহজে পালন করতে পারে। এদেশে অনেক ক্ষেত্রে অধীনস্থদের সততা ও দক্ষতার অভাব থাকায় তারা নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে পারে না।
৩. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিগত সমস্যা (Problem of information and communication technology): ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নে উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করছে। তবে আমাদের দেশে দক্ষ লোকের অভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি করতে পারেনি। তাই, প্রয়োজনীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবে ব্যবস্থাপকীয় কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হয়।
৪. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি (Corruption and nepotism): দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করে সততার সাথে কাজ করলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জন সহজ হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের লোকসান দিতে হচ্ছে।
৫. লালফিতার দৌরাত্ম্য (Red tapism): লালফিতার দৌরাত্ম্য ও আমলাতান্ত্রিকতা এদেশের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। তাছাড়া, আমাদের দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখন পর্যন্ত শতভাগ জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। জোরালো জবাবদিহিতা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকদের মধ্যে কাজের প্রতি অনীহা দেখা যায়। এটি দক্ষ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বাধা।
৬. পরামর্শ সেবার অভাব (Lack of consultancy service): বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অনেক পরামর্শদানকারী সংস্থা রয়েছে, যারা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের গবেষণাকার্য পরিচালনা করে এসব সংস্থা সমস্যা সমাধানের উপায় আবিষ্কার করে থাকে। আমাদের দেশে এ ধরনের পরমার্শদানকারী সংস্থার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
৭. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training): প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্বাহীর উন্নয়ন এবং উপযুক্ত কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে না পারলে দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু, বাংলাদেশে উপযুক্ত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখনও গড়ে ওঠেনি।
৮. শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের অভাব (Lack of labour management relationship): বাংলাদেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মী ও ব্যবস্থাপকের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রয়েছে। এতে সামান্য ব্যাপারে তারা পরস্পরের বিরোধিতা। করে। ফলে ব্যবস্থাপকের পক্ষে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন করে উদ্দেশ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
৯. রাজনৈতিক পরিস্থিতি (Political situation): রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেশের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক কারণে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে কখনও কখনও অসন্তোষজনক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ফলে ধর্মঘট, অবরোধ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। এতে ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সব সময় তৎপর।
১০. সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাধা (Obstacles in decision making and implementing): বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো মহল তাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে সব সময় ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ তৈরি করে। এতে ব্যবস্থাপকরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
১১. কাজের সঠিক মূল্যায়নের অভাব (Lack of proper evaluation of activities): ব্যবস্থাপকীয় কার্যাবলির সঠিক মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনমতো সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উন্নত বিশ্বে ব্যবস্থাপনা নিরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ পদ্ধতির প্রচলন হয়নি। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপকীয় দুর্নীতি করার সুযোগ পান, যা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বাধা।
১২. মূলধনের সমস্যা (Capital problem): এদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। চলতি মূলধনের অভাবে অনেক সময় প্রতিষ্ঠান তাদের দৈনন্দিন কার্যাবলি স্বাভাবিক গতিতে চালাতে পারে না। এতে ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।
১৩. সরকারি উদ্যোগ (Governmental Initiative): সরকার উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি নিলে কর্মীদের মনোবল বেড়ে যায়। ফলে তারা উৎসাহ নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। আমাদের দেশে কর্মীদের উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয় কর্মসূচির অভাব রয়েছে। ফলে ব্যবস্থাপনার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
সুতরাং, এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লিখিত সমস্যার সমাধান হলেই বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনাকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব হবে।