আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা| Skills of a Good Manager

দক্ষতা বলতে কোনো কাজ করার জন্য ব্যক্তির সামর্থ্য বা যোগ্যতাকে বোঝায়। এর দ্বারা ব্যক্তি দক্ষতা তার অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কম সময়ে ও অল্প খরচে সঠিকভাবে কাজটি করতে পারে। সময়, অর্থ, উপকরণ ও শ্রমের ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা বলতে প্রতিষ্ঠানের উপকরণ ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের ফলাফল অর্জনের সামর্থ্য মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনের সামর্থ্যকে বোঝায়।

প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সব উপাদান বিদ্যমান থাকলেও দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাবে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করা যায় না। বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় জগতে টিকে থেকে দ্রুত সাফল্য লাভ করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবস্থাপকীয় ভূমিকা পালনে একজন ব্যবস্থাপকের কিছু বিশেষ দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। রিকি, ডব্লিউ, গ্রিফিন (Ricky W. Griffin) সাত ধরনের ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার কথা বলেছেন, যথা: কারিগরি দক্ষতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, ধারণাগত দক্ষতা, সমস্যা অনুধাবনের দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা এবং সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা।
আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা
১৯৭৪ সালে রবার্ট এল. ক্যাজ (Robert L. Katz) ব্যবস্থাপকের দক্ষতার ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি ব্যবস্থাপকের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি দক্ষতার কথা বলেন, যথা:

১. ধারণাগত দক্ষতা
২. মানবীয় দক্ষতা এবং
৩. কারিগরি দক্ষতা

তাছাড়া, অন্যান্য ব্যবস্থাপনা পণ্ডিত ব্যক্তিরা আরও কিছু দক্ষতার কথা বলেছেন। একজন ব্যবস্থাপকের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা নিচে আলোচনা করা হলো:

আদর্শ ব্যবস্থাপকের মৌলিক দক্ষতা | Basic skills of good manager


১. কারিগরি দক্ষতা (Technical skills): কোনো কাজ কীভাবে করতে হবে সে সংক্রান্ত বিশেষ ও স্বতন্ত্র ধারণাকে কারিগরি দক্ষতা বলে। অর্থাৎ, কাজ সম্পাদনে যে বিশেষ পদ্ধতি, কলা- কৌশল বা যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারাই হলো কারিগরি দক্ষতা। যেমন: হিসাববিজ্ঞান, প্রকৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান প্রভৃতি। কারিগরি দক্ষতা নিম্ন স্তরের নির্বাহীদের জন্য খুবই প্রয়োজন। কেননা, এ স্তরের নির্বাহীরা তাদের অধীনস্থদের কাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। প্রত্যেক ব্যবস্থাপকের জন্য কারিগরি দক্ষতা একটি বিশেষ এবং অপরিহার্য দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জনের পেছনে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের কারিগরি দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যও এই দক্ষতা প্রয়োজন।

২. মানবীয় বা আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা (Human or interpersonal skills): কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করার সামর্থ্যকে মানবীয় সম্পর্কগত বা আন্তঃব্যক্তিক (Interpersonal) দক্ষতা বলা হয়। কর্মীদের দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের আবেগ-অনুভূতি, মনোভাব ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে হয়। এজন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। সফল ব্যবস্থাপককে তার উর্ধ্বতন ও অধস্তনদের সাথে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার দক্ষ হতে হয়। মানবীয় সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানের সব স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মীসহ সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত স পক্ষের (বিনিয়োগকারী, সরবরাহকারী, গ্রাহক, সরকার, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান) সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টিতে পারদর্শী হতে হয়। অর্থাৎ, একজন ব্যবস্থাপককে তার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। এ দক্ষতা সব স্তরের ব্যবস্থাপকদের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

৩. ধারণাগত দক্ষতা (Conceptual skills): কোনো নতুন বা অজানা বিষয় নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্যকে ধারণাগত বা কল্পনা সংক্রান্ত দক্ষতা বলে। প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে সুস্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন হয়। ধারণা ভুল হলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য সামগ্রিক কার্যকলাপ, পরিবেশের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক অনুমান করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপককে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আর এক্ষেত্রে উচ্চ স্তরের ব্যবস্থাপনাকে প্রচুর মানসিক শ্রম ব্যয় করতে হয়।

৪. সমস্যা অনুধাবনের দক্ষতা (Diagnostic skills): প্রতিষ্ঠানের কোনো সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করে সঠিকভাবে সমাধান করার সামর্থ্যকে সমস্যা অনুধাবনের দক্ষতা বলে। ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের পথে দুর্বলতা ও বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হয়। সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন বিকল্প থেকে সঠিক ও কার্যকর উপায় নির্ধারণে তাকে দক্ষ হতে হয়। সমস্যা নির্ণয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা অর্জন করা প্রত্যেক স্তরের ব্যবস্থাপকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবস্থাপনার উচ্চ স্তরে এরূপ দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। আইনজীবী ও ডাক্তারদের জন্য এ ধরনের দক্ষতা বেশি দরকার হয়।

আদর্শ ব্যবস্থাপকের অন্যান্য দক্ষতা| Other skills of a Good Manager


১. সাংগঠনিক দক্ষতা (Organizational skill): একজন ব্যবস্থাপককে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজ সম্পাদনের জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তাকে প্রতিষ্ঠানের উপকরণাদির সদ্ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এজন্য ব্যবস্থাপকের সাংগঠনিক জ্ঞান থাকা জরুরি।

২. সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা (Time management skills): সময় ব্যবস্থাপনা বলতে নির্দিষ্ট কাজগুলো কখন ও কত সময়ের মধ্যে করা উচিত, তার জন্য পরিকল্পনা ও সংগঠিত করাকে বোঝায়। একজন ব্যবস্থাপকের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ নির্দিষ্ট করা ও দক্ষতার সাথে তা করাকে সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বলে। ব্যবস্থাপককে লক্ষ রাখতে হবে যাতে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অবহেলিত না থাকে। তাছাড়া, কোনো কর্মী যাতে অলসভাবে সময় না। কাটায় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, 'সময়ই অর্থ' (Time is money)।

৩. বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা (Analytical skills): ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানে দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি ও কলা-কৌশলের প্রয়োগ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন সম্পর্কিত গুণকে বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা বলে। এরূপ দক্ষতার মাধ্যমে সমস্যা নির্ণয় করে মূল্যায়ন করা হয়। এজন্য ব্যবস্থাপককে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বিশ্লেষণ করে তার জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করতে হয়। দীর্ঘস্থায়ী সফলতা অর্জনের জন্য এরূপ দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. যোগাযোগ দক্ষতা (Communication skills): যোগাযোগ হলো তথ্য, সংবাদ বা ভাবের আদান-প্রদান। প্রতিষ্ঠানের ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সামর্থ্যকে যোগাযোগ দক্ষতা বলে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপককে তার মতামত, ধ্যান-ধারণা ও তথ্য অধীনস্থ কর্মীদেরকে জানানো উচিত। একইভাবে অধীনস্থদের ধ্যান-ধারণা ও পরামর্শ নেওয়ার মানসিকতাও ব্যবস্থাপকের থাকা জরুরি।

৫. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক দক্ষতা (ICT related skills): আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপককে কম্পিউটারের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আধুনিক ব্যবস্থাপকরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে সহজেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে পারেন।

উপসংহারে বলা যায়, আলোচিত দক্ষতাগুলো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থাপকদের অর্জন করতে হয়। তবে বিভিন্ন স্তরে দক্ষতার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন: কারিগরি দক্ষতা নিম্ন স্তরে বেশি প্রয়োজন। অন্যদিকে সমস্যা নির্ণয় ও ধারণামূলক দক্ষতা উচ্চ স্তরে বেশি থাকা আবশ্যক। আর মানবীয় দক্ষতা সব স্তরের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url