ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য | The Characteristics of Management

কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে তার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হয়। আধুনিক বিশ্বে পরিবার, ক্লাব, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপকীয় কার্যক্রম সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিচে ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য
১. অবিরাম প্রক্রিয়া (Continuous process): পরস্পর নির্ভরশীল ও ধারাবাহিক কাজের সমষ্টিকে প্রক্রিয়া বলা হয়। ব্যবস্থাপনা হলো একটি গতিশীল, অবিরাম ও ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়া। শুধু একটি কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শেষ হয় না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপককে সংগঠিতকরণ, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ সব সময় করতে হয়।

২. লক্ষ্য অর্জনের উপায় (Means of achieving goals): কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মূল ইচ্ছা/অভিপ্রায় বা কাঙ্ক্ষিত ফলকে লক্ষ্য বলে। এই লক্ষ্য অর্জনের ধাপ বা মাইলফলককে উদ্দেশ্য বলা হয়। যেকোনো প্রচেষ্টার মূলে এই লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ব্যবস্থাপনার কাজ পরিচালিত হয়।

৩. সামাজিক প্রক্রিয়া (Social process): সামাজিক প্রক্রিয়া বলতে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করাকে বোঝায়। মালিক, শ্রমিক, সরবরাহকারী, ভোক্তা, সরকারসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সমাজের সব পক্ষকে নিয়ে এবং সবার কল্যাণের জন্য ব্যবস্থাপনার কাজগুলো করতে হয়। এতে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি সম্পাদনের সাথে সামাজিক উদ্দেশ্যও অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই, ব্যবস্থাপনা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া।

৪. অস্পর্শনীয় (Intangible): ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সরাসরি দেখা বা ধরা যায় না। কিন্তু একে অনুভব করা যায়। অর্থাৎ, ব্যবস্থাপনার কোনো শারীরিক উপস্থিতি (Appearance) নেই। ব্যবস্থাপকদের পরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, প্রেষণা, নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনাকে উপলব্ধি করা যায়।

৫. কাজ আদায়ের কৌশল (Technique of getting work done ): ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন সম্পদ ও উপকরণকে যথাযথভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ব্যবস্থাপক নেতৃত্ব, নির্দেশনা, প্রেষণার ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কর্মীদের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তাই, ব্যবস্থাপনা হলো অন্যদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়ার একটি কৌশল।

৬. দলীয় কর্মপ্রচেষ্টা (Group efforts): দলীয় কর্মপ্রচেষ্টা হলো একই লক্ষ্য অর্জনে একাধিক দল ব্যক্তির মিলিত হয়ে কাজ করা। ব্যবস্থাপনাও একটি দলগত কর্মপ্রচেষ্টা। প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের একক কর্মপ্রচেষ্টার সমষ্টির ফলাফল অপেক্ষা যৌথ প্রচেষ্টার ফলাফল বেশি কার্যকর, যা সিনার্জি (Synergy) প্রভাব হিসেবে পরিচিত। তাই লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হয়। দলের কোনো একজনের ব্যর্থতায় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য Teny ও Franklin বলেছেন, ব্যবস্থাপনা কাজের সাথে সম্পৃক্ত।

৭. অর্থনৈতিক সম্পদ (Economic resource): উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং আর্থিক মূল্য আছে এমন বস্তু বা বিষয়কে অর্থনৈতিক সম্পদ বলা হয়। যেমন: ভূমি, মানবসম্পদ, পুঁজি প্রভৃতি। বর্তমানে ব্যবস্থাপনাও মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্য সব উপায়-উপকরণ সঠিক মাত্রায় থাকার পরও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হতে পারে। এজন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনাকে অর্থনৈতিক সম্পদ বলা হয়।

৮. সর্বজনীনতা (Universality): সব সময় সব ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য বিষয়কে সর্বজনীন সর্বজনীন বলা হয়। ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন হিসেবে পরিচিত। পরিবার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এর প্রয়োগ লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্যই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, "ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন।

৯. বিজ্ঞান ও কলা (Science and art): পরীক্ষিত ও সুশৃঙ্খল জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয়। অন্যদিকে জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ কৌশলকে বলা হয় কলা। ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান ও কলা কলা দুটোই। ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও তত্ত্ব সুশৃঙ্খল থাকায় একে বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা যায়। অন্যদিকে, ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন কলা-কৌশলকে কাজে লাগিয়ে কাজ আদায় করে নেওয়া যায়। এজন্য একে কলা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

১০. ব্যবস্থাপনা একটি পেশা (Management is a profession): কোনো কাজের বিশেষায়িত ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করাকে পেশা বলা হয়। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে ব্যবস্থাপনা পেশার মর্যাদা পাচ্ছে। আমাদের দেশে ধীরে হলেও ব্যবস্থাপনা পেশা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, এদেশের ব্যবস্থাপকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন ও কনসালটেন্সি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করছেন।

১১. জ্ঞানের বিশেষ শাখা (Special branch of knowledge): ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়া দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপকীয় কাজ পরিচালনা করা কঠিন হয়। পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে ব্যবস্থাপনার নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সব দেশেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যকর আছে। তাই জ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে বর্তমানে ব্যবস্থাপনা সর্বত্রই স্বীকৃত।

তাই বলা যায়, ব্যবস্থাপনা হলো একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র বিষয়। ব্যবস্থাপনা বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে হলে উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url