খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা
অবাধ খাদ্য সরবরাহ এবং সারা বছর খাদ্যের পর্যাপ্ত প্রাপাতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু খাদ্য নয়, স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সরবরাহ প্রয়োজন যার ফলে মানুষের কর্মোদ্যম, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা বেশ পুরানো। প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে মিসরীয় ও চায়না সভ্যতায়ও এর প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। তখনও দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় খাদ্য মজুদ করে রাখা হতো। গত শতাব্দীর ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণা আনুষ্ঠানিক (formal) রূপ লাভ করে। তখন হতে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণাটি জাতীয় পর্যায়ে চিন্তার বিষয় হিসেবে বিবেচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, পর্যাপ্ত খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদন ও এর দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা।
১৯৮৩ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) কর্তৃক খাদ্য নিরাপত্তার ধারণাটিকে আরও প্রসারিত করে বলা হয় খাদ্য নিরাপত্তা সকল মানুষের সমগ্র জীবনের জন্য মৌলিক খাদ্য প্রাপ্তির ভৌত এবং অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তাকে নির্দেশ করে।
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দারিদ্রা ও ক্ষুধা সংক্রান্ত এক রিপোর্টে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে বলা হয়, "খাদ্য নিরাপত্তা বলতে সকল মানুষ সমগ্র জীবনব্যাপী কার্যকর ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খানা প্রাপ্তির নিশ্চয়তাকে বোঝায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (USDA) এর মতে,
খানা নিরাপত্তার অর্থ হলো একটি পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সর্বদা পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা যাতে তারা একটি কর্মঠ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে।
ধারণার প্রসারণ বিবর্তনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা পাওয়া যায় ১৯৯৬ সালের বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে। এ সম্মেলনে বলা হয়, “খাদ্য নিরাপত্তা হলো এরূপ একটি বিষয় যেখানে জনগণ সবসময় ভৌত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যে প্রবেশাধিকার লাভ করে যা তাদের সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় জীবনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি সম্মত প্রয়োজন মেটায়।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এই সংজ্ঞাটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক (Dimensions) হলো:
1. খাদ্যের প্রাপ্যতা (Food availability)
2. খাদ্যের ক্রয়যোগ্যতা (Food access)
3. খাদ্যের উপযোগিতা (Food Utilization)
4. (iv) খাদ্যের স্থিতিশীলতা (Food Stability)
অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি, নির্ভরশীল স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগান যা ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
খাদ্য নিরাপত্তা প্রকারভেদ
১. গৃহগত বা পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা
২. জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা
পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি প্রতিটি পরিবারের পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহের সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল, এর মাধ্যমে পরিবারের প্রতিটি লোক সর্বদা স্বাস্থ্যবান এবং কর্মক্ষম থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য খেতে পারে। একইভাবে, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা সারা দেশের জনগণের জন্য যথেষ্ট, প্রয়োজনীয়, অবাধ এবং মানসম্মত খাদ্য সংগ্রহের সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য তিনটি প্রধান বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তা হলো:
ক. প্রথমত, একটি পরিবার ও গোটা জাতির প্রয়োজনীয় মোট খাদ্যের প্রাপ্যতা।
খ. দ্বিতীয়ত, স্থানভেদে এবং ঋতুভেদে খাদ্য সরবরাহের যুক্তিসঙ্গত স্থায়িত্ব।
গ. তৃতীয়ত, নির্বিঘ্ন এবং মানসম্মত পরিমাণ খাদ্যে প্রত্যেক পরিবারের ভৌত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবাধ অধিকারের নিশ্চয়তা।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় ঝুঁকি। প্রশ্ন হলো কীভাবে এই বিশ্বের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে পারি? ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে জনসংখ্যা হবে ৯ বিলিয়ন। ২ এখনও ১ বিলিয়ন লোক দৈনিক খাবার থেকে বঞ্চিত থাকে। একই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে ভোগ অভ্যাস। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে এ পথে যাত্রা তত আশাপ্রদ নয়। মানুষের প্রথম মৌলিক ও মানবিক অধিকার হলো খাদ্য। আমাদের খাদ্য চাহিদা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পারিবারিক, সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে নিরবচ্ছিন্ন। এজন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, মঞ্জুত প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বণ্টন প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় সমাধান হলো উৎপাদন বৃদ্ধি যা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ ভূমি, পানি ও প্রাকৃতিক অন্যান্য সম্পাদক মধ্যে গ্রামীণ উন্নয়নই হলো খাদ্য নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।
খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি
১. খাদ্যের যোগান: বাংলাদেশে খাদ্যের যোগান নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, খাদ্য আমদানি এবং বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত খাদ্য সাহায্যের উপর। গত তিন দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিলো ১৪৯.৭ লক্ষ মেট্রিক টন যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৭৫.০৮ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। ১৯৯৫/৯৬ সালে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিলো ২৪.২৭ লক্ষ মেট্রিক টন যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৮.৭২ লক্ষ মেট্রিক টনে। তথ্য উপাত্ত হতে বোঝা যায় বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন জরুরি বিষয়
২. দারিদ্র্য প্রবণতা: বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি অঞ্চলভেদে বিভিন্ন। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় উপজেলা, জেলাগুলোতে দারিদ্র্যের প্রাবাল্য বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেও একই রকম। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া এবং বান্দরবান, রাঙামাটি জেলাসমূহে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। পুষ্টিকর খাবারের আশা না করে শুধুমাত্র খাবার এখানে সবাই প্রত্যাশা করলেও দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে তা সংস্থান করতে পারে না। দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যা বেশি। দারিদ্র্যের উচ্চসীমা অনুযায়ী পল্লি এলাকায় রংপুর, বরিশাল, ঢাকায় এবং শহর এলাকায় বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীতে দারিদ্র্যের হার বেশি। জমির মালিকানার ভিত্তিতে দারিদ্র্য প্রবণতা ২০১০ সালের উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে দারিদ্র্য পরিমাপে দেখা যায়, জনসংখ্যার ৩৫.৪ শতাংশ ভূমিহীন, ৪৫.১ শতাংশের জমির পরিমাণ ০.০৫ একরের নিচে, ৩৩.৩ শতাংশের জমির পরিমাণ ০.৫-০.৪৯ একর, ২৫.৩ শতাংশের ০.০৫-১.৪৯ একর। নিম্ন দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে দেখা যায় ২৭.৮ শতাংশের জমির পরিমাণ ০.৫ একরের নিচে, ১৭.৭ শতাংশ জমির পরিমাণ ০.০৫-০.৪৯ একর, ১৩.৩ শতাংশের জমির পরিমাণ ১.৫-২.৪৯ একর।
৩. খাদ্য ভোগ এবং স্বাস্থ্য বিধি পূর্বে উল্লেখিত বাংলাদেশের দারিদ্রা পরিস্থিতি এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দ্বারা বোঝা যায়, স্বাস্থ্য বিধি না মেনে শুধুমাত্র জীবন বাঁচানোর জন্যও সকল মানুষের তিন বেলা খাবার সংস্থান হয় না। খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার হার বেশ উচ্চ। পুষ্টিহীনতার এ সমস্যা বাংলাদেশে দূর করা সম্ভব না হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে না।
৪. শিক্ষা: দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ( ৩৭.৭%) এখনো সাক্ষরতার বাইরে। মৌলিক শিক্ষা যা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে এবং উচ্চ শিক্ষার হার আরও কম। শিক্ষার সাথে জীবনমান উন্নত করার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত শিক্ষার অভাবে সচেতন হতে পারেনি, তাই তারা খাদ্যের মান ও পুষ্টিগত গুণাবলি সম্পর্কেও সচেতন নয়।
৫. জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন, পরিবেশ দূষণ, পানি সেচের সংকট, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, উত্তরাঞ্চলে মরুময়তা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
৬. বিবিধ কারণ এদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, দুর্বল গ্রামীণ অবকাঠামো, দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, কৃষি উৎপাদন বাড়লেও প্রতি বছর খাদ্য আমদানি করতে হয় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। এছাড়া স্বল্প সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সিডর প্রভৃতির ফলে ভাসমান ছিন্নমূল মানুষের মিছিল বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশ ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা অর্জিত হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ, দরিদ্র এবং ভূমিহীন প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি ও সংগ্রহের জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করা না হলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার স্থায়ী অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকার বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে একটি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিখাত সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা বড় ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
১. নীতি প্রণয়ন: বিশ্বখাদ্য সম্মেলন ১৯৯৬ পরবর্তী সরকার এবং দাতাদেশ ও সংস্থা বাংলাদেশে খাদ্য নীতি প্রণয়নে উদ্যোগী হয়। সে লক্ষ্যে National Food Policy Plan of Action এবং Investment Plan for Food Security and Nutrition প্রণয়ন করা হয়। এতে সমন্বিতভাবে খাদ্য নিরাপত্তার সকল দিক (all Dimensions) যেমন খাদ্যের প্রাপ্যতা, ক্রয়যোগ্যতা, উপযোগিতা বা ব্যবহার গুরুত্ব পায়। তিনটি মূল লক্ষকে কেন্দ্র করে খাদ্য নীতি প্রণীত হয়। তা হলো সরবরাহ।
ক. নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের পর্যাপ্ত ও স্থিতিশীল
খ. ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ।
গ. সবার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। বিশেষত মহিলা ও শিশুদের জন্য অগ্রাধিকার।
২. দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: আমরা জানি, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন না হলে আমদানি নির্ভরতার উপর দাঁড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল হিসাবে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। এ লক্ষ্যে ইউরিয়া ব্যতীত সকল প্রকার সারের মূল্য অর্ধেকে কমিয়ে আনা, ভালো বীজ সহজলভ্য করা, ডিজেলের মূল্যে কৃষককে ভর্তুকি দেয়া, ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ সহজলভ্যকরণ ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ও সেচ যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণ সহজ করাসহ কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। এতে কৃষকরা ফসল উৎপাদনে উৎসাহী হয়। সরকার কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দিকেও লক্ষ রেখেছে। একই সাথে নিরাপদ খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করছে।
৩. কৃষির সার্বিক উন্নয়ন: খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এ লক্ষ্যে ক্ষুদ্রসেচ সম্প্রসারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, উন্নত মানের ও উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
৪. কৃষি গবেষণায় গুরুত্ব প্রদান: কৃষকের চাহিদা ও বাজার চাহিদাভিত্তিক কীটপতঙ্গ রোগবালাই মুক্ত, খরা/লবণাক্ততা সহিষ্ণু, আবহাওয়া ও পরিবেশ উপযোগী এবং স্বল্প সময়ে (Short duration) ফসল পাওয়া যায় এরূপ শস্যের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণসহ সার্বিক কৃষি গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পরমাণু ও বায়োটেকনোলজি পদ্ধতি ব্যবহার করে লবণাক্ততা সহিষ্ণু এবং স্বল্পসময়ের শস্যের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
৫. ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সহায়তা: দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের উৎপাদিত শস্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হওয়ার কারণে তাদেরকে শস্যমূল্য সহায়তার জন্য কৃষিবিমা এবং কৃষক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
৬. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ: শস্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে Endowment Fund গঠন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার সারাদেশে ১ কোটি ৪৩ লক্ষ ৭৫ হাজার কৃষক পরিবারের মধ্যে উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করেছে।
৭. কৃষি জমির আওতা সম্প্রসারণ: লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল উপকূলীয় এলাকা ধান চাষের আওতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আবার স্বল্প সময়ের (সর্বোচ্চ ১১০ দিন) শস্যের জাত চাষের ফলে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণ সম্ভব হয়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও হাওর এলাকায় পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃষি জমির আওতা সম্প্রসারণ ও একাধিক ফসল উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
৮. অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ: সরকার প্রতি বছরে কৃষকদের মূল্য সহায়তা ও খাদ্য নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ হয়েছিল ১৪.০৪ লক্ষ মে. টন এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ১৫.৫০ লক্ষ মে. টন।
৯. খাদ্যশস্য আমদানি: খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্য চাহিদার একটি বিরাট অংশ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে, নীতিমালার মধ্য থেকে প্রতি বছর আমদানি করে থাকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিলো ৩১.২৪ লক্ষ মেট্রিক টন।
১০. দুর্যোগ মোকাবেলা: বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে এ সময়ে দুর্গত মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের। এছাড়া রয়েছে মোট জনসংখ্যার ৩১ ভাগ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং কৃষিখাতের বিপুল সংখ্যক মৌসুমি বেকার। এরূপ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে সরকার। একই সাথে দুর্যোগ মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থাপনার উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
১১. খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ: খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সমাজের সকল শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য সহজে খাদ্য প্রাপ্তি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাজারে খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অতি মুনাফার লোভে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারকে বাজারে খাদ্যশস্যের সরবরাহ বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করতে হয়। এ কৌশল হিসাবে সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি বা ওএমএস কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে ঢাকা ও আশেপাশের শ্রমঘন এলাকায় (নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার ও গাজীপুর) প্রায় সারাবছর এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। এর পাশাপাশি সুলভ মূল্য কার্ড বা ফেয়ার প্রাইজ কার্ডের মাধ্যমে প্রতি পরিবারকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট। পরিমাণ চাল ও গম দেয়া হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওএমএস কর্মসূচি ও ফেয়ার প্রাইজ কার্ডের মাধ্যমে ২০.৮৭ লাখ টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয় এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ২৫.৪৯ লক্ষ মে. টন খাদ্যশস্য বিতরণের সংস্থান রাখা হয়েছে।
১২. মঙ্গা ও মৌসুমি দারিদ্র্য নিরসনে পদক্ষেপ: দেশের উত্তরাঞ্চল, উপকূলবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলসহ দেশের অনেক এলাকার বিপুল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠী বছরের দুটি সময়ে (মার্চ-এপ্রিল এবং অক্টোবর-নভেম্বর) হাতে কোনো কাজ থাকে না। আয়ের কোনো উৎস না থাকায় বাজারে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ থাকলেও তাদের পক্ষে তা কিনে খাওয়া সম্ভব হয় না। উত্তরাঞ্চলের এরূপ খাদ্যাভাবকে আধাদুর্ভিক্ষ বা মঙ্গা নামে পরিচিত। এরূপ খাদ্যাভাব দূর করতে অতি দরিদ্রদের জন্য ১০০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচি নামে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো:
(ক) অতি দরিদ্র বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি,
(খ) সার্বিকভাবে জনগোষ্ঠী ও দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টি করা এবং
(গ) গ্রামীণ এলাকায় ক্ষুদ্র পরিসরে অবকাঠামো ও যোগাযোগ উন্নয়ন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়ন।
এছাড়া মৌসুমি বেকারদের জন্য ৮০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প রয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত ৫টি জেলা। যথা : রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম এলাকায় কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা এসেছে।
১৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে ২০০৮ থেকে ২০১৫ মেয়াদি বাংলাদেশ ফুড পলিসি অ্যাকশন প্ল্যান (Bangladesh Food Policy Action Plan, 2008-2015) গ্রহণ করে। এর আলোকে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা বিনিয়োগ পরিকল্পনা (Bangladesh Food Security Country Investment Plan-CIP) প্রণয়ন করা হয়। দানাদার খাদ্যশস্যসহ পুষ্টিকর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। একই সাথে কৃষি ফসল, মৎস্য চাষ, পশু সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজার নিশ্চিতকরণসহ ১২টি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
একটি আদর্শ পরিকল্পনা হিসাবে CIP ২০১০ সালের জুলাই মাসে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিনিয়োগ ফোরাম' এ মডেল হিসেবে উপস্থাপন করে এবং বাংলাদেশকে দৃষ্টান্তমূলক দেশ (Show Case Country) হিসেবে তুলে ধরা হয়। একইভাবে অক্টোবর, ২০১০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা কমিটির ৩৬তম সভায় বাংলাদেশের ‘খাদ্য নিরাপত্তা বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর ফলশ্র“তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথ সুগম হয়। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি (GAFSP) থেকে ৩৭০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়া গেছে।
১৪. নিম্ন আয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তি কর্মসূচি: দেশের বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য
প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। এ শ্রেণির (দরিদ্র, হতদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী, গার্মেন্টস শ্রমিক ও অন্যান্য) জনগোষ্ঠীর জন্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার (Public Food Distribution Systems) আওতায় নানা ধরনের কর্মসূচি রয়েছে। এ সব কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা। এর মধ্যে রয়েছে
১. দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ),
২. দুর্যোগকালীন ত্রাণ হিসাবে দুর্গতদের জন্য খাদ্য সহায়তা দেয়া, এ্যাটিউইটাস রিলিফ (জিআর),
৩. খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করা,
৪. খাদ্যশস্যের বিনিময়ে গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন (টস্ট রিলিফ- টিআর/কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা),
৫. ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি ইত্যাদি। এছাড়াও সরকার সারাদেশে ৭৭ লক্ষ পরিবারের তালিকা প্রণয়ন করেছে। ভবিষ্যতে বছরব্যাপী এ কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থার উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার সামাজিক উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৩০,৭৫১.১১ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে নীতি ও কৌশল নির্ধারণপূর্বক একটি 'জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল' (National Social Protection Strategy) প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ এবং এ কর্মকান্ডকে জোরদার করা সম্ভব হয়েছে।
১৫. খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্য মজুদ: ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিরিখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পূর্বের ১৫ লাখ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন খাদ্যগুদামের সাথে আরও সাত লাখ টন বাড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে এ ধারণ ক্ষমতা ৩০ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করে এবং বিদেশ হতে আমদানি করে এ মজুত গড়ে তোলা হয়।