বাংলাদেশের বীমা শিল্পের সমস্যাসমূহ
১. বীমার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে জানাতে এবং আগ্রহ সৃষ্টি করতে কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক প্রচারণা বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। জনমনে বীমাশিল্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কার্যক্রম গ্রহণ করা না হলে এ শিল্প প্রসারের সম্ভাবনা সীমিতই থাকবে।
২. স্বল্প শিক্ষিত বিক্রয়কর্মী যারা মাঠপর্যায়ে বীমা পণ্য (Insurance Product) বিক্রয়কাজে জড়িত, তাদের প্রশিক্ষণ না থাকায় গ্রাহককে বীমা সম্পর্কে আলোকিত না করে প্রলুব্ধ করে। বীমা এজেন্ট নিয়োগের আইনগত শর্ত হচ্ছে, লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পর লাইসেন্স প্রদান। কিন্তু এটি প্রতিপালিত হচ্ছে না। ফলে অদক্ষ ও অযোগ্য বিক্রয়কর্মীর দ্বারা মানুষ অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছে।
৩. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের এজেন্টগণ অনেক সময় গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের টাকার বিপরীতে ভুয়া রশিদ প্রদান করে। এক্ষেত্রে বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এজেন্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও গ্রাহক স্বার্থ নিশ্চিত হয় না অর্থাৎ গ্রাহকগণ টাকার প্রকৃত রশিদ পায় না। ফলে কোন দাবিও উত্থাপন করতে পারেনা। এক্ষেত্রে গ্রাহক স্বার্থ
সংরক্ষণে কর্মীর প্রতারণার দায় প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করার ব্যবস্থা করা যায়। কর্মীর প্রতারণার নায় প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হলে গ্রাহক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৪. বীমা বিক্রয়কর্মীদের আইন অনুযায়ী যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স এর জন্য পরীক্ষা নিশ্চিত না করায় তাদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধি পরিপালনে অসুবিধা হয়।
৫. গ্রাহকদের দাবি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তদন্তের নামে নানারকম জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বীমা সম্পর্কে গ্রাহকদের ধারণা নেতিবাচক হয়ে থাকে। গ্রাহকরা পর্যন্ত সেবা অনেক ক্ষেত্রেই পায় না। যেমন: সময়মত প্রিমিয়াম নোটিশপ্রাপ্তি, কিস্তির ধরন পরিবর্তন, ঠিকানা পরিবর্তন, রেকর্ড পরিবর্তন ইত্যাদি সেবা পায় না।
৬. দেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বীমা শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত। উপরন্ত বীমা কোম্পানিগুলোর পক্ষেও সাধারণের জন্য বীমা লিটারেসির কোন কর্মসূচী না থাকায় জনসাধারণের মধ্যে বীমার প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি হয়না।
৭. গ্রাহকদের দাবি ও সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভোগান্তি দূর করার কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে অভিযোগ বক্স না থাকা বা অভিযোগ নিষ্পত্তির কোন ব্যবস্থা না থাকায় এসব ভোগান্তি নিরসনের উপায় থাকে না।
৮. দেশে একটি বীমা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান অনেক আগেই গঠিত হওয়া সত্ত্বেও বীমা খাতে মানব সম্পদ উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট -এ বীমা সম্পর্কিত স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম নেই। সে কারণে বীমা শিক্ষার প্রসার কম।
৯. বাংলাদেশে নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ব্যতীত পুণঃবীমা প্রতিষ্ঠান না থাকায় প্রতি বছর প্রচুর অর্থ পুনঃবীমা প্রিমিয়াম বাবদ বিদেশে চলে যায়, যদিও 'নিট আউট ফ্লো' বাংলাদেশের অনুকূলে। শক্তিশালী পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান গঠন না করা হলে আশপাশের দেশ তথা ইউরোপীয় পুণঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা কমানো যাবে না। পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ আইনগত ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রণয়ন প্রয়োজ
১০. বীমা কোম্পানিসমূহের মুখ্য নির্বাহী ব্যতীত অন্যান্য উচ্চ পদধারীদের জন্য বীমা ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ বা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রী থাকার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যার ফলে তরুণ প্রজন্মের বীমা বিষয়ে পড়ালেখা করার কোন আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না।
১১. দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
১২. বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধিমালার মাধ্যমে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সুস্পষ্ট কর্মপরিধির অভাব।
১৩. পেশাগত বীমা শিক্ষা যেমন: ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, প্রশিক্ষণ ইত্যাদিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করায় বীমা শিল্প উন্নয়নে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা।
১৪. বীমা কোম্পানিসমূহে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এর অভাব।
১৫. জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহে অ্যাকচ্যুয়ারির অভাব।
১৬. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহে মূলধনের অপর্যাপ্ততা।
১৭. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অভাব।
১৮. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহে উচ্চ হারে ব্যবস্থাপনা বায়।
১৯. তামাদি পলিসির ব্যাপকতা।
২০. দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির উপযোগী বীমা পলিসির বিষয়ে বীমা কোম্পানিসমূহের উদ্যোগের অভাব।
২১. আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা।
২২. পলিসি নবায়নের নিম্নহার।
২৩. বীমা শিল্প প্রসারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ -এর অনুপস্থিতি।
২৪. অধিকাংশ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানাসহ যাবতীয় সম্পত্তি পরিপূর্ণ বীমা সুবিধার আওতায় না আসায় দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক জান-মাল ও সম্পদের ক্ষতিজনিত কারণে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।
২৫. লাভযোগ্য যাতে লাইফ ফান্ডের বিনিয়োগ নিশ্চিতে সহায়ক যুগোপযোগী বিধির অনুপস্থিতি।
২৬. বিভিন্ন জীবন বীমাকারীর বীমা পলিসির অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রিমিয়াম রেট।
২৭. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের “কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা” এর অভাব।
২৮. বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহে নীতি ও নৈতিকতার আলোকে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার অভাব।
২৯. বীমা ডিপ্লোমা ডিগ্রি, অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল সায়েন্সসহ অন্যান্য পেশাগত ডিগ্রি প্রদানের অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা।
৩০. বীমা শিল্পের জন্য প্রমিত আচরণবিধির অনুপস্থিতি।
৩১. বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীদের কার্যকর গোষ্ঠীবামার আওতায় আনয়নে অনীহা।
৩২. বামা শিল্পের সময়োপযোগী প্রমিত হিসাব পদ্ধতির অভাব।
৩৩. International Association of Insurance Supervisors (IAIS) -এর মত আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রণীত Insurance Core Principle (ICP) মেনে চলার সক্ষমতা না থাকা।
৩৪. কৃষি প্রধান বাংলাদেশে বন্যা, দুর্ণিঝড়, টর্নেডো, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানির মত বিপর্যয়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় বীমা শিল্পকে কাজে লাগানোর কার্যকর পরিকল্পনা না থাকা।
৩৫. বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে জীবন, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধে সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীর জ্ঞানের অভাব। বীমার জন্য ব্যয়িত অর্থকে পরিবারের ও ব্যবসায়ের অতিরিক্ত খরচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৩৬. অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু নির্মিত অবকাঠামোর ঝুঁকি মোকাবেলার লক্ষ্যে বীমার আওতায় আনা হচ্ছে না।
৩৭. উন্নয়ন বান্ধব ইফেরটিভ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক-এর অনুপস্থিতি।
৪৮. বীমা শিল্পের সামগ্রিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব।
৩৯. আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক নানাবিধ বীমাপণ্য যেমন- ক্ষুদ্র বীমা, তাকাফুল, কৃষি বীমা (ক্লাইমেট বেইজড) -এর অনুপস্থিতি এবং এগুলোর বিতরণ চ্যানেল বহুমুখীকরণ (যেমন- Bancassurance, সমবায় সমিতি ইউনিয়ন কাউন্সিল, পৌরসভা ইত্যাদি) -এর উদ্যোগের অভাব।
৪০. ভূরিত গতিতে প্রিমিয়াম রেমিটেন্স এবং অবিলম্বে দাবি পরিশোধ-এর লক্ষ্যে 'কোড অব মার্কেট কন্ডাক্টর' না থাকা।
৪১. আর্থিক রিপোর্ট প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের লক্ষ্যে IFRS এর অনুসরণের অক্ষমতা।
৪২. গ্রাহক সন্তুষ্টি (Client Satisfaction) বিষয়ে জরিপের ব্যবস্থা না থাকা।