শ্রমের দক্ষতা || Efficiency of Labour
শ্রমের দক্ষতা কাকে বলে?
শ্রমের দক্ষতা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সাধারণভাবে শ্রমের দক্ষতা বলতে শ্রমিকের কাজ করার ক্ষমতাকে বোঝায়। যে শ্রমিক যতো কাজ করতে পারে সে ততো দক্ষ।
অর্থনীতিতে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কাজের গুণাগুণকে অক্ষুণ্ণ রেখে শ্রমিক যে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী বা সেবা - কর্ম উৎপাদন করতে পারে, তাকে শ্রমের দক্ষতা বলে অর্থনীতিবিদ হেটাল মেহেতা (Mehta) বলেন,
শ্রমের দক্ষতা বলতে শ্রমিকের সামর্থ্যকে বোঝায় যা থেকে শ্রমের উৎপাদনশীলতা সৃষ্টি হয়।
শ্রমের দক্ষতার নির্ধারকসমূহ
শ্রমিকের কাজ করার ক্ষমতাকে শ্রমের দক্ষতা বলে। শ্রমের দক্ষতা বাড়লে শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। অর্থাৎ দক্ষ শ্রমিক বলতে কম সময়ে অধিক পণ্য উৎপাদন করতে পারে এমন শ্রমিকদের বোঝায়। উন্নত দেশগুলোতে শ্রমের দক্ষতা বেশি হওয়ায় সেখানে উৎপাদনের পরিমাণ ও মান দুই - ই বেশি। একজন শ্রমিক দক্ষ নাকি অদক্ষ তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। শ্রমের দক্ষতার নির্ধারকসমূহ হলো—
১. কাজ করার ইচ্ছা: শ্রমিকের কাজ করার ইচ্ছার ওপর শ্রমের দক্ষতা অনেকটা নির্ভর করে। শ্রমিকের কাজ করার ইচ্ছাও আবার অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন—
ক. চাকরির স্থায়িত্ব: শ্রমিকের চাকরি স্থায়ীত্বের জন্য বেশি কাজ করতে আগ্রহী হবে। ফলে তার দক্ষতা বাড়বে।
খ. পদোন্নতি: চাকরিতে পদোন্নতি হলে কাজের আগ্রহ বাড়বে। ফলে শ্রমিকের দক্ষতাও বাড়বে।
গ. মজুরি: শ্রমিকের মজুরি বেশি হলে সে কাজ করতে বেশি আগ্রহী হয় । কেননা মজুরি বেশি হলে তার জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয় ।
ঘ. অনুকূল শর্তাবলি: কাজের শর্তাবলি যদি শ্রমিকের অনুকূলে থাকে তাহলে কর্মদক্ষতা বাড়বে।
ঙ. অন্যান্য সুবিধা: উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো ছাড়াও অন্যান্য সুযোগ - সুবিধা; যেমন— চাকরির ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা, নিয়মিত মজুরি প্রদান, লভ্যাংশের অংশ প্রদান, ভাতা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, চাকরির সুবিধা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর দক্ষতা নির্ভর করে।
২. কাজ করার ক্ষমতা: কাজ করার সামর্থ্যের ওপর শ্রমের দক্ষতা নির্ভরশীল। কাজ করার সামর্থ্য আবার নির্ভর করে শ্রমিকের শারীরিক যোগ্যতা, নৃ - তাত্ত্বিক পরিচয়, জলবায়ু, খাদ্য, বুদ্ধিমত্তা, নৈতিক ও চরিত্রগত গুণাগুণ, কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর।
৩. কারখানার পরিবেশ: কারখানার চারপাশ ও ভিতরের অবস্থা পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন, প্রচুর আলো - বাতাস যুক্ত হলে এবং কারখানায় শৃঙ্খলা থাকলে শ্রমিকের দেহ - মন সুস্থ থাকে । ফলে তার দক্ষতা বাড়ে।
৪. আধুনিক যন্ত্রপাতি: কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম এবং নতুন নতুন উৎপাদন কৌশল ব্যবহার করা হলে শ্রমিকরা কাজে উৎসাহ বোধ করে। এর ফলে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। উন্নত দেশের শ্রমিক নিত্য - নতুন উৎপাদন পদ্ধতি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে বলে তাদের দক্ষতা অনেক বেশি।
৫. সংগঠনের নৈপুণ্য: কারখানার পরিচালন ব্যবস্থা দক্ষ ও উচ্চমানসম্পন্ন হলে সেখানকার শ্রমিকের দক্ষতা এবং কাজের ইচ্ছা সহজেই বৃদ্ধি পায়।
৬. সামাজিক নিরাপত্তা: কারখানায় কাজের সময় কোনো দুর্ঘটনায় শ্রমিক পঙ্গু বা অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হতে পারে বা তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। এরকম অবস্থায় আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ দান, বিমা, বৃদ্ধ বয়সে পেনশন প্রভৃতি সুযোগ - সুবিধা প্রচলিত থাকলে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার অবসান ঘটে। ফলে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়তে পারে।
এছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গঠনমূলক শ্রমিক সংঘ, নিয়োগকারীর সাথে সুসম্পর্ক, কারখানার অব্যাহত উন্নতি প্রভৃতি বিষয় শ্রমিকের দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে শ্রমিকের দক্ষতা
উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের দক্ষতা খুব কম। এজন্য নিম্নলিখিত কারণগুলো দায়ী।
১. বাংলাদেশে অধিকাংশ কল - কারখানার সামগ্রিক পরিবেশ ভালো নয়। কারখানার ভিতরে আলো - বাতাসের পাশাপাশি পরিষ্কার - পরিচ্ছন্নতা ও কাজে শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। এরকম মন্দ পরিবেশের কারণে শ্রমিকদের দক্ষতা কম হয়। এছাড়া আমাদের দেশে বেশিরভাগ কলকারখানায় পুরাতন ও জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম ব্যবহার হয়। উৎপাদন কলাকৌশলও পুরনো এবং ব্যবহৃত কাঁচামাল নিম্নমানের। এ কারণেও শ্রমিকদের দক্ষতা কম।
২. উপযুক্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে এ দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান খুব নিচু । ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক কর্মোদ্যম কম। এছাড়া উষ্ণ জলবায়ু আমাদের শ্রমিকদের কাজের সামর্থ্যকে ব্যাহত করে।
৩. নিম্ন মজুরি, কাজের প্রতিকূল শর্তাবলি, কাজের স্থায়িত্ব, চাকরিতে উন্নতির অভাব, অন্যান্য সুযোগ - সুবিধার অভাব প্রভৃতি কারণে এ দেশের শ্রমিকদের কাজে অনীহা সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের দক্ষতা বাড়ে না।
৪. বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারখানা বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যবস্থা নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ। দুর্ঘটনা ও অন্যান্য বিপদকালে শ্রমিকরা খুব কমই সাহায্য পায়। এছাড়াও রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ। এসব কারণে এ দেশের অধিকাংশ শ্রমিকের দক্ষতা কম।
বাংলাদেশে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির উপায়
১. শ্রমিকের কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যুক্তিসঙ্গত বেতন - ভাতা, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদির সুব্যবস্থা করতে হবে। এতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং কাজের দক্ষতা বাড়বে।
২. শ্রমিকদের কাজ করার ইচ্ছা বৃদ্ধির জন্য চাকরির স্থায়িত্ব, চাকরিতে উন্নতি অবসর ভাতা, বিপদকালীন সাহায্য, বোনাস, চিত্তবিনোদনেরব্যবস্থা প্রভৃতি সুযোগ - সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
৩. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও দক্ষ হলে শ্রমিকদের কাজের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। সাথে সাথে তাদের দক্ষতাও বাড়বে।
৪. কলকারখানার পরিবেশ যাতে উন্নত হয় সেজন্য পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখা দরকার।
৫. শ্রমিকরা যাতে উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল শিখতে পারে সেজন্য কলকারখানায় আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। সাথে সাথে উদ্যোক্তাগণ নব নব উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শ্রমিকদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের চেষ্টা করতে পারেন।
৬. শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন কল্যাণমূলক শ্রম আইন প্রণয়ন করতে হবে। গঠনমূলক ও সুপরিচালিত শ্রমিক সংঘ গঠনের সুযোগ থাকতে হবে। দেশে যথাসম্ভব সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি বজায় রাখতে হবে। শ্রমিক - মালিক সুসম্পর্ক সৃষ্টি ও তা বজায় রাখতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এ দেশে শ্রমের দক্ষতা বাড়বে এবং দেশের শিল্পোন্নয়নে সহায়ক হবে।