ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি |Managerial Economics

সবক্ষেত্রে যখন বিজ্ঞানের জয়জয়কার তখন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এর সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এফ ডব্লিউ টেইলর প্রবর্তিত ব্যবস্থাপনা তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনাকে সবদিক থেকে সফল করার জন্য পরিমাপক হিসেবে যেটিকে বিবেচনা করা হয়, তা হলো প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতা। পাশাপাশি আরও একটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়, তা হলো সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় এবং দক্ষতার সাথে 
প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানসম্পন্ন দ্রব্য উৎপাদন কণার ক্ষমতা। 

এসব বিষয়ই কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক চলক ও পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং যুগের প্রয়োজনেই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনাকে সফল করে তোলার স্বার্থে একজন ব্যবস্থাপককে অর্থনীতি পাঠেও মনোনিবেশ করতে হয়। তাহলে একজন ব্যবস্থাপককে কি একই সঙ্গে অর্থনীতি বিষয়েও বিশেষজ্ঞ হতে হব!

কখনোই না, বরং ব্যবস্থাপনীয় কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ব্যবস্থাপনীয় চলকগুলো যেসব অর্থনৈতিক চলকের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় সেগুলোর প্রকৃতি, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সেগুলোর আচরণ, প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রায়োগিক সম্ভাবনার বিষয়ে একজন ব্যবস্থাপকের অবগত থাকা প্রয়োজন। সুতরাং প্রয়োজন হয়ে পড়ে ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত অর্থনীতির পাঠ। আর সে প্রয়োজন থেকেই সৃষ্টি ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি শাস্ত্রটির।

Managerial Economics

ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি কি?


ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতি এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি কথাটি গঠিত। সুতরাং ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে প্রথমত ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতি বলতে কী বোঝায়, তা জানা প্রয়োজন।

হেনরি ফয়েলের মতে,
ব্যবস্থাপনার কাজ হচ্ছে অনুমান ও পরিকল্পনা গ্রহণ, সংগঠন, নির্দেশনা প্রদান, সমন্বয় সাধন এবং নিয়ন্ত্রণ।

এখানে সম্ভবতই প্রশ্ন জাগে পূর্বোক্ত কাজগুলো কার জন্য কে করে? বস্তুত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বলতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকেই বোঝায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়। সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে অনুমান প্রণয়ন ও পরিকল্পনা গ্রহণ, কর্মী ও কার্যাবলিকে সংগঠিত করা, কর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান, বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো এবং সার্বিক কার্যাবলির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপকে ব্যবস্থাপনা বলা হয়।

অপরদিকে অর্থনীতি বলতে এমন একটি শাস্ত্রকে বোঝায়, যা সীমিত সম্পদ ও আয় নিয়ে অসীম অভাব পূরণের নিমিত্তে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করে।

স্যামুয়েলসনের মতে,
ব্যক্তি ও সমাজ অর্থ বা অর্থ ছাড়া কেমন করে দুষ্প্রাপ্য উৎপাদনশীল সম্পদকে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য উৎপাদনের কাজে নিয়োগের জন্য নির্বাচন করে এবং কীভাবে সমাজ ও জনসাধারণের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভোগের নিমিত্তে উক্ত সম্পদ বণ্টিত হয়, তা নিয়ে অর্থনীতি আলোচনা করে।
এখন আমরা ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদানের উদ্যোগ নিতে পারি। প্রথমেই বলা উচিত যে, ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি কথাটি মূলত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর এ প্রতিষ্ঠান বলতে সাধারণত বাণিজ্যিক তথা উৎপাদনকারী, বিক্রয়কারী, বিপনণকারী ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকেই বোঝায়। সুতরাং, কোন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দ্যেশ্যাবলী অর্জনের নিমিত্তে এর সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যেসব ব্যবস্থাপকীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক তত্ত্বের পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ সম্ভাব্যতা নির্ণয় সম্পর্কে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাকেই ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি বলে।

কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের প্রধান কাজ হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ বলতে একাধিক কার্যক্রমের মধ্যে কোন একটিকে বেছে নেয়াকে বোঝায়। অপরদিকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন বলতে ভবিষ্যতে কোন কাজ কি মাত্রয় কিভাবে কোন কোন সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে কতটুকু সময়ের সধ্যে সম্পন্ন হবে এবং তার জন্য কি পরিমাণ ব্যয় হবে বা তার থেকে কি পরিমাণ আয় উপার্জন করতে হবে সে সম্পর্কে একটি সুসমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়নকে বোঝায়।

কিন্তু যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি সম্পন্ন হয় সম্পূর্ন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে। বস্তুত, যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয় অতীত তথ্য, চলতি তথ্য এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথাসম্ভব সঠিক অনুমানের মাধ্যমে। এরূপ অনিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের সাহায্য নিলে কার্যধারা আরও সহজ হয়। যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে ব্যাবসায়ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া হয়, সেসব পদ্ধতি এবং তৎসংযুক্ত কর্মকাঠামোকে বলা হয় ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি।

বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্নভাবে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন-

হেগের মতে,

ব্যাবসায়ের সমস্যা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তা করার কার্যকরী রাস্তা নির্দেশ করে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি, যা অর্থনীতি গণিত এবং পরিসংখ্যানের যুক্তিসমূহ ব্যবহার করে।

এম সি নেয়ার এবং মেরিয়ামের মতে,
ব্যাবসায়িক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা চিন্তাধারার ব্যবহারসংক্রান্ত কাজে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি ব্যাপৃত।

ম্যান্সফিল্ড-এর মতে,
খাটি বিশ্লেষণমূলক সমস্যাদি বা অর্থনৈতিক তত্ত্বের কৌতূহল থেকে সৃষ্ট এবং ব্যবস্থাপকদের আবশ্যকীয়ভাবে মুখোমুখি হতে হয় এমন নীতি-নির্ধারণী সমস্যা- এ দুয়ের মধ্যে একটি সেতু রচনার উদ্যোগ নেয় ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি।

জোয়েল ডীন-এর মতে,
ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে কীভাবে অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যাবসায়িক নীতি-নির্ধারণে ব্যবহৃত হয় তা দেখানো।

সুতরাং ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি বলতে এমন একটি শাস্ত্রকে বোঝায়, যা ব্যাবসায় ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের প্রয়োগসমূহের আলোচনা করে থাকে।

ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ


ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এবং এর বিষয়বস্তুর পরিধি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা একান্ত আবশ্যক। ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির কতগুলো বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হলো- 

১. ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা: ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি মূলত ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করে। কারন এই অর্থনীতির বিশ্লেষণের একক হলো প্রতিষ্ঠান। সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণের জন্য ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি ব্যবহৃত হয় না।

২. প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা: ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি সাধারণত কোনো ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে। এছাড়া অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের মধ্যে মুনাফা তত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করে।

৩. প্রতিষ্ঠানের জটিলতা নিরসনসংক্রান্ত আলোচনা: ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের প্রয়োগক্ষেত্রে যেসব অসম্পূর্ণতা ও জটিলতা রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ ব্যাবসায়িক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণের জন্য অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের প্রয়োগসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি কাজ করে।

৪. আদর্শগত অর্থনৈতিক আলোচনা: সাধারণ অর্থনীতি শুধু অর্থনীতির বিভিন্ন চলকের মধ্যে সর্বজনীন সম্পর্ককে প্রকাশ করে। কিন্তু উক্ত চলকগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক কাম্য বা কীরূপ সম্পর্ক বিরাজ করলে প্রতিষ্ঠানের অধিক আর্থিক সুবিধা অর্জিত হবে, তা অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে উক্ত অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে কীভাবে উক্ত সম্পর্ক কাম্য অবস্থায় আনা যায় তা নিয়ে আলোচনা করে।

৫. সামষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা: কোন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অনেক সময় বিভিন্ন সামষ্টিক চলক যেমন মুদ্রাস্ফীতি, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, সরকারী রাজস্ব ও আর্থিক নীতি ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর এসব যেহেতু সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় সেহেতু ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতেও সামষ্টিক অর্থনৈতিক আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আওতা ও পরিধি


ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির কোনো সুনির্দিষ্ট আওতা বা সীমারেখা নির্দেশ করা অত্যন্ত কঠিন। কেননা বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন বিষয়াদিকে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বস্তুত সময়ের পরিবর্তনে ব্যাবসায়িক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, পরিধি ও জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও নীতিমালা প্রয়োগের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ জন্যই ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় তথা এর পরিধি স্থির। নয় বরং পরিবর্তনশীল। যে সকল বিষয় সাধারণভাবে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে আলোচিত হয়ে থাকে সেগুলো নিম্ন আলোচনা করা হলো-

১. চাহিদা বিশ্লেষণ ও চাহিদা অনুমান: কোনো প্রতিষ্ঠান উৎপাদনকারী বা ব্যাবসায়িক যা-ই হোক না কেন যদি এর দ্রব্যের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে উৎপাদন, বিক্রয়, দাম নির্ধারণ, মুনাফা নির্ধারণ ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া কষ্ট হয়ে পড়ে। তাই ব্যবস্থাপকগণকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে চাহিদার সাধারণ অর্থনৈতিক বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ভবিষ্যৎ চাহিদার পরিমাণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে হয় এবং সেই অনুযায়ী চাহিদার পরিমাণ। কতটুকু হতে পারে তা অনুমান করতে হয়। চাহিদা বিশ্লেষণ ও চাহিদা অনুমান করতে গিয়ে যেসব কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তার সবই ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

২. খরচ এবং উৎপাদন বিশ্লেষণ: পরিকল্পনা গ্রহণ, দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ, মুনাফার পরিমাণ নির্ধারণ, বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাই ইত্যাদির জন্য খরচ বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। খরচ বলতে অর্থনৈতিক খরচকেই বোঝায়, অর্থাৎ পরিবর্তনশীল এবং স্থায়ী খরচ বিশ্লেষণ করতে হয়। এর জন্য হিসাবস্থিত তথ্যাদি এবং বিভিন্ন সম্ভাব্য অবস্থার প্রেক্ষিতে গৃহীত অনুমান দুই-ই প্রয়োজন। অপরদিকে উৎপাদন বিশ্লেষণপূর্বক উৎপাদনের পরিমাণ, উৎপাদিত দ্রব্যের গুনগতমান, উৎপাদন কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করা যায়, যা বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এভাবে খরচ এবং উৎপাদন বিশ্লেষনের জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তার সবই ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। কারণ, খরচ এবং উৎপাদন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যেসব চলক বিবেচনা করা হয়, যেমন- স্থির খরচ, পরিবর্তনশীল খরচ ইত্যাদি অর্থনৈতিক চলক রূপে পরিচিত। আবার যেসব পদ্ধতি আরোপিত হয় যেমন- ভারসাম্যাবস্থা বিশ্লেষণ, উৎপাদন অপেক্ষক, খরচ উৎপাদন সম্পর্ক বিশ্লেষণ ইতাদিও ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচা বিষয়।

৩. দাম নির্ধারণসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, নীতিমালা এবং প্রযোগ: যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নিকটই দাম নির্ধারনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দ্রব্যের দাম যদি ক্রেতাদের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় তাহলে প্রত্যাশিত হারে মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়, বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায় এবং সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তটি সফল ও সার্থক হয়। দ্রব্যর দামসংক্রান্ত যেসব বিধি ও নীতিমালা সাধারণ অর্থনৈতিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত সেসবকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বাস্তব পরিস্থিতিতে কোন প্রতিষ্ঠানের দ্রব্যের দাম নির্ধারণ করা যায় তা ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে আলোচিত হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয়াদি হলো দাম নির্ধারণ পদ্ধতি, পার্থক্যমূলক দাম নির্ধারণ, দাম পূর্বানুমান ইত্যাদি।

৪. মুনাফা ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য হলো মুনাফা সর্বাধিককরণ। এর জন্য প্রতিটি বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে সম্ভাব্য কী হারে আয় উপার্জিত হতে পারে, উক্ত হারে আয় উপার্জনের জন্য কী পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে, অর্জিত লাভের কতটুকু পুনর্বিনিয়োগ করা হবে এবং কতটুকু আবণ্টিত হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন রয়েছে। আর এসংক্রান্ত কার্যক্রম তথা মুনাফা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কার্যক্রম ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

৫. মূলধন ব্যবস্থাপনা: ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির অন্যতম বিষয়বস্তু হলো মূলধন ব্যবস্থাপনা। মূলধন ব্যবস্থাপনা বলতে প্রয়োজনীয় মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ, ন্যূনতম খরচের মূলধনের উৎস বাছাই ও মূলধন সংগ্রহ, সংগৃহীত মূলধন সর্বাধিক লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ ইত্যাদিকে বোঝায়। এই প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে মূলধন কাঠামো অনুযায়ী মূলধন সংগ্রহ, সংগৃহীত মূলধন কীভাবে লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যায়, অর্থাৎ বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন, বিনিয়োগ কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে আলোচিত হয়ে থাকে।

সুতরাং ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির সার্বিক আলোচ্য বিষয়সমূহ একটিমাত্র বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়, তা হলো প্রতিষ্ঠানের আয় সর্বাধিককরণ। এই আয় সর্বাধিককরণ করার লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠানসমূহ চাহিদা বিশ্লেষণ ও চাহিদা পূর্বানুমানের মাধ্যমে কাম্য উৎপাদন স্তর নির্ধারণ করে, চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্রব্যের দাম নির্ধারণ করে, উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করে এবং সর্বোপরি পূর্বনির্ধারিত হারে আয় উপার্জনকে নিশ্চিত করার জন্য মুনাফা ব্যবস্থাপনা করে থাকে। আর এই সার্বিক কার্যক্রম যেহেতু ঝুঁকিবহুল পরিস্থিতিতে সম্পন্ন হয়, তাই প্রতিষ্ঠানসমূহ সবসময় চেষ্টা করে ঝুঁকি ও আয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে।

ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য


অনেকেই ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিকে পৃথক একটি শাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের মতে, ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি সাধারণ অর্থনীতিরই একটি অংশমাত্র। প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থনীতির সাথে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির কিছু মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ-

১. অর্থনীতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নীতিমালার কাঠামো নিয়েই আলোচনা করে, কিন্তু ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি উক্ত নীতিমালার বাস্তব প্রায়োগিক রূপরেখা কীরূপ হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করে।

২. ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য এমনই যে এর বিষয়বস্তু কেবল ব্যষ্টিক অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অপরদিকে অর্থনীতি বলতে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক উভয় প্রকার অর্থনীতিকেই বোঝায়।

৩. সাধারণ ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন উৎপাদন ও উপকরণাদির মধ্যে আয়ের বণ্টন নিয়ে আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ ভূমির খাজনা, শ্রমের মজুরি, মূলধনের সুদ, সংগঠনের জন্য মুনাফা ইত্যাদি বিষয়াদিই ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। কিন্তু ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি কেবল মুনাফা বণ্টনসংক্রান্ত তত্ত্ব নিয়েই প্রধানত আলোচনা করে থাকে।

৪. ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মুনাফা সর্বাধিককরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সাধারণ অর্থনীতি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য অর্জনের পথ নির্দেশ করে না। এটি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক চলকগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।

৫. সাধারণ অর্থনীতি হলো বর্ণনামূলক আর ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি হলো উদ্দেশ্যমূলক।

৬. সাধারণ অর্থনীতিতে অতীত পরিসাংখ্যিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত তত্ত্বসমূহ আলোচিত হয়। কিন্তু ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে অতীত পরিসাংখ্যিক তথ্যের ভিত্তিতে বর্ণিত তত্ত্বসমূহ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে কীরূপ ধারণ করতে পারে তাও নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালানো হয়।

ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


আধুনিক বৃহদায়তন উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ক্ষুদ্রায়তন প্রতিষ্ঠানসমূহ সাধারণত তাদের অতীত অভিজ্ঞতা এবং সরাসরি অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোনোক্রমে তাদের বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদন এবং কার্যক্রমের দিক থেকে বৃহৎ আকারের অথবা যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন ধরনের দ্রব্যের উৎপাদন এবং বিক্রয়ের সাথে জড়িত সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এতটা জটিল এবং অনিশ্চিত যে তাদের পক্ষে শুধুমাত্র অনুমানপ্রসূত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।

সফলভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। তাই এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহকে অর্থনীতির সাধারণ বিধি বা নিয়মাবলিকে নিজস্ব আঙ্গিকে কীভাবে সফলভাবে প্রয়োগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় সেই চেষ্টাই করতে হয়। অর্থাৎ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

মিল্টন এইচ স্পেন্সার এবং লুইস সিগেলম্যান-এর মতে, ব্যাবসায় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অর্থনীতির প্রয়োগ বা ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের সমন্বয় সাধনের বিষয়টি নিম্নোক্ত কারণে গুরুত্বপূর্ণ-

১. সনাতনী তাত্ত্বিক অর্থনৈতিক ধারণাসমূহকে প্রকৃত ব্যাবসায়িক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য করে তোলার জন্য ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আশ্রয় নিতে হয়। অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহে সাধারণত বিভিন্ন অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছু মডেল দাঁড় করানো হয় এবং প্রতিষ্ঠানসমুহের জন্য সম্ভাব্য কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। কিন্তু এসব অনুমানের কারণে উক্ত মডের বা তত্ত্বসমূহ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রকৃত কার্যক্রমের ব্যাখ্যা সেসব তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রকৃত ব্যাবসায়িক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন অর্থনৈতিক তত্ত্বকে অর্থবহ এবং এর অনুমানসমূহকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যাখ্যাযোগ্য করে তুলতেই হয়। তাই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নিকট সাধারণ অর্থনীতির চেয়ে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

২. বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনুমান তথা চাহিদার বিভিন্ন প্রকার স্থিতিস্থাপকতা পরিমাপের জন্য ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আশ্রয় নিতে পারে। যেমন আয় স্থিতিস্থাপকতা, দাম স্থিতিস্থাপকতা, আড়াআড়ি স্থিতিস্থাপকতা, বিক্রয় প্রসারণ স্থিতিস্থাপকতা, খরচ উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়াদি পরিমাপের মাধ্যমে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পূর্বানুমান করা হয়।

৩. বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক পরিমাণ নির্ধারণের জন্যও ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির আশ্রয় নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ মুনাফা, চাহিদা, উৎপাদন, খরচ, দাম, মূলধন ইত্যাদির কথা বলা যেতে পারে। এসব পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয় এজন্যই যে, এসব পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যমে অনিশ্চিৎ পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপকগণ মোটামুটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারেন। ৪. বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক পরিমাণ নির্ধারণের পর সেগুলোর ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকার ব্যাবসায়িক নীতি যেমন- দামনীতি, বিক্রয়নীতি, ক্রয়নীতি, কর্মীনীতি ইত্যাদি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। অর্থনৈতিক পরিমাণসমূহ নির্ধারণের সময় এমনভাবে কার্যক্রম সম্পাদিত হয় যে কোনো কৌশল অবলম্বন করা হলে কী ধরনের ফলাফল দেখা দিতে পারে এবং সেসবের সম্ভাবনার পরিমাণ কীরূপ তাও নির্ধারিত হয়। ফলে বিভিন্ন বিকল্প কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক কৌশলটি বেছে নেয়া যায়।

৫. কোনো প্রতিষ্ঠান যে অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে কাজ করে এবং যেসব অর্থনৈতিক বাহ্যিক শক্তির সাথে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন হয়। সেসব অর্থনৈতিক পরিবেশ ও প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিকে অনুধাবনের জন্য ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির প্রয়োগ ঘটাতে হয়। যেমন জাতীয় আয়ের পরিবর্তন, মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন, সরকারি রাজস্ব ও মুদ্রানীতির পরিবর্তন, বাণিজ্যচক্রের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো একদিকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে থাকে, অপরদিকে একক ভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানও এসব বাহ্যিক পরিবেশ ও শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই প্রতিষ্ঠানের উচিত বাহ্যিক অর্থনৈতিক পরিবেশ ও শক্তিকে বিশ্লেষণ, অনুধাবন এবং যথাসম্ভব সেসবের প্রতিকূলতাকে কমানোর প্রচেষ্টা চালানো। আর এই প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।

বস্তুত বর্তমানে অর্থনৈতিক জটিলতা ও অস্থিতিশীলতা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই নতুন নতুন তত্ত্ব ও নীতিমালা নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে। কিন্তু এসব তত্ত্ব ও নীতিমালা সময়োপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এগুলোকে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য ব্যবস্থাপকীয় অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যকীয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url