ব্যষ্টিক অর্থনীতি এবং সামষ্টিক অর্থনীতি || Micro Economics & Macro Economics
ব্যষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে?
ব্যষ্টিক অর্থনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Micro Economics’। ‘Micro’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Mikros’ থেকে। এর বাংলা অর্থ ব্যষ্টিক অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র (very small)। যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অসংখ্য এককের সমষ্টি। প্রতিটি এককের আচরণ ও কার্যকলাপ যখন পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তখন তাকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলা হয়।
অধ্যাপক মরিস ভব এর মতে, অর্থনীতির অনুবীক্ষণিক অবলোকন ও বিশ্লেষণকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলে। সামগ্রিক অর্থনীতির প্রতিটি একক এক একটি ক্ষুদ্র অংশ। এ ক্ষুদ্র অংশের আচরণ ও কর্মপদ্ধতি আলোচনা করাই ব্যষ্টিক অর্থনীতির কাজ। যেমন— একজন ভোক্তার চাহিদা, বিক্রেতার যোগান, কোনো দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ, কোনো ব্যক্তির আয় - ব্যয় ও সঞ্চয়, কোনো উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের দাম ও উৎপাদন নীতি, কোনো দ্রব্যের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা নির্ণয় ইত্যাদি ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের আওতায় পড়ে। ব্যষ্টিক অর্থনীতির ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হলো ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শালের (১৮৪২-১৯২৪) ‘The Principles of Economics’ যা ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ কে. ই. বোলডিং (১৯১০-১৯৯৩) -এর মতে,
ব্যষ্টিক অর্থনীতি এক একটি ফার্ম, প্রত্যেক পরিবার, প্রত্যেকটি দ্রব্যের দাম, মজুরি, আয়, প্রত্যেকটি শিল্প এবং প্রত্যেক দ্রব্য সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করে।
সূতরাং ব্যষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক ঘটনাকে একক ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা।
সামষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে?
সামষ্টিক অর্থনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Macro Economics’। ‘Macro’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Makros’ থেকে। এর বাংলা অর্থ সামষ্টিক অর্থাৎ বৃহৎ বা সামগ্রিক (Large or whole)। অর্থনীতির ধারণা বা ঘটনাকে সামগ্রিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে তথা জাতীয় পর্যায়ে বিশ্লেষণ করাকে সামষ্টিক অর্থনীতি বলে।
অন্যভাবে বলা যায়, অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যাকে একক বা খণ্ড খণ্ডভাবে ব্যাখ্যা না করে সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে তাকে সামষ্টিক অর্থনীতি বলা হয়। যেমন— একটি দেশের মোট জাতীয় আয়, মোট লোকসংখ্যা নিরূপণ, জাতীয় বেকারত্বের কারণ ও ফলাফল নিরূপণ, মোট চাহিদা, মোট যোগান, জাতীয় সঞ্চয়, জাতীয় বিনিয়োগ, সাধারণ মূল্যস্তর, মোট সঞ্চয়, মোট সুদ ও মজুরির হার ইত্যাদি নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি আলোচনা করে।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ কে. ই. বোলডিং - এর মতে,
সামষ্টিক অর্থনীতি কোনো ব্যক্তির আয়ের জাতীয় আয়, কোনো নির্দিষ্ট দ্রব্যমূল্যের পরিবর্তে সাধারণ মূল্যস্তর, দ্রব্যের ব্যক্তিগত উৎপাদনের পরিবর্তে জাতীয় উৎপাদন আলোচনা করে।
ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে তুলনা
অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতির আলোচনা ক্ষেত্রকে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক এ দুটি প্রধান শাখায় ভাগ করেছেন । ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য রয়েছে।
১. উদ্ভবের দিক থেকে: ইংরেজি Micro শব্দটি গ্রিক শব্দ Mikros থেকে উদ্ভব হয়েছে। Micro শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র। অন্যদিকে ইংরেজি Macro শব্দটি গ্রিক শব্দ Makros থেকে উদ্ভব হয়েছে। Macro শব্দের অর্থ বৃহৎ।
২. সংজ্ঞাগত: অর্থনীতির যে শাখায় অর্থব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক যেমন- একজন ভোগকারী, একটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, একটি শিল্প ইত্যাদির আচরণ বিশ্লেষণ করা হয়, তাকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলে। অন্যদিকে, অর্থনীতির যে শাখায় অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক দিক তথা- মোট ভোগ ব্যয়, মোট বিনিয়োগ ব্যয়, জাতীয় আয় ইত্যাদি আলোচনা করা হয়, তাকে সামষ্টিক অর্থনীতি বলে।
৩. পরিধিগত: ব্যষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ও আওতা ছোট বা ক্ষুদ্র। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি ও আওতা ব্যাপক ও বিস্তৃত।
৪. বিশ্লেষণগত: ব্যষ্টিক অর্থনীতি একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতি একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আলোচনা না করে অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে।
৫. বিষয়গত: ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিষয় হলো একজন ভোক্তার বা একক ফার্মের আচরণ, চাহিদা, ভোগ, আয়, ব্যয়, সঞ্চয় ইত্যাদি। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয় হলো একটি দেশের মোট উৎপাদন, জাতীয় আয়, মোট চাহিদা, মোট যোগান, জাতীয় সঞ্চয়, জাতীয় বিনিয়োগ, সাধারণ মূল্যস্তর ইত্যাদি।
৬. আলোচনার ভিত্তিতে: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হয় বিধায় এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকে না। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ সামগ্রিকভাবে আলোচনা করা হয় বলে এদের মধ্যে যোগসূত্র থাকে।
৭. অর্থনৈতিক চিত্রগত: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণের খন্ড বা আংশিক চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণের সামগ্রিক বা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।
৮. পূর্ণ নিয়োগের ভিত্তিতে: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে একটি দেশে পূর্ণ নিয়োগ অবস্থা বিরাজমান বলে ধরে নেয়া হয়। যা অবাস্তব ধারণা। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে কখনোই দেশে পূর্ণ নিয়োগ অবস্থা বিদ্যমান ধরে নেয়া যায় না।
৯. ভারসাম্যগত: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আংশিক ভারসাম্য বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভারসাম্যের অবস্থা তুলে ধরে।
১০. খাতগত: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে একক খাত বিশ্লেষণে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
১১. প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা: কোনো দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোকে নির্ণয় করা যায় না। পক্ষান্তরে, কোনো দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সামষ্টিক অর্থনীতির আলোকে নির্ণয় করা যায়।
১২. সমর্থক: ক্লাসিক্যাল ও নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ ব্যষ্টিক অর্থনীতির সমর্থক। অপরপক্ষে, আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ সামষ্টিক অর্থনীতির সমর্থক।
১৩. প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই: ব্যষ্টিক অর্থনীতির ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই হলো ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শালের ‘Principles of Economics’ যা ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই হলো ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্স - এর ‘The General Theory of Employment, Interest and Money’ যা ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়।
কিছু কিছু অনৈক্য, অমিল এবং বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ পরস্পর নির্ভরশীল তাই এক্লি বলেন,
ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য করা যায় না।
পল এ . স্যামুয়েলসন বলেন,
ব্যষ্টিক ও সামষ্টিকের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি উভয়ই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।