মিশ্র অর্থব্যবস্থা || Mixed Economic

মিশ্র অর্থব্যবস্থা কি?


যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানা ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ বিরাজ করে, তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে। অর্থাৎ এ ধরনের অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগ সম্মিলিত ভূমিকা পালন করে। অন্যভাবে বলা যায়, যে অর্থব্যবস্থা ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দুর্বলতা পরিত্যাগ করে এবং উত্তম গুণগুলো গ্রহণ করে গড়ে ওঠে তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা (Mixed Economy) বলে।

অধ্যাপক পি. এ. স্যামুয়েলসন - এর মতে,
মিশ্র অর্থব্যবস্থা এমন একটি অর্থব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন ও ভোগ কার্য সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার সাথে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটে।
 
অধ্যাপক J. F. Ragan ও L. B. Thomas বলেন,
মিশ্র অর্থনীতি এমন একটি অর্থব্যবস্থা যেখানে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে।

কিছু সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় এবং অন্যগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহের কিছু বাজারে এবং কিছু কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়। উন্নত, উন্নয়নশীল, স্বল্প উন্নত পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রেই মিশ্র অর্থব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি।
মিশ্র অর্থব্যবস্থা || Mixed economic

মিশ্র অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত মিশ্র অর্থব্যবস্থার মাত্রাগত পার্থক্য আছে। বিশুদ্ধ মিশ্র অর্থব্যবস্থায় নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায়:

১. সম্পদের ব্যক্তিগত ও সরকারি মালিকানা: মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের ন্যায় অধিকাংশ সম্পদ ও উৎপাদনের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগের প্রধান প্রধান মাধ্যম, বিশেষ ধরনের শিল্প, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারি মালিকানায় থাকে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি অবস্থান করে। 
 
২. সরকারি বিনিয়োগ: জনগুরুত্বপূর্ণ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত খাতগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ পরিচালিত হয়। মৌলিক ও ভারী শিল্পকারখানা, গুরুত্বপূর্ণ আমদানি - রপ্তানি সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। 

 ৩. বেসরকারি বিনিয়োগ: সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসায় - বাণিজ্য এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানার বিনিয়োগ পরিচালিত হয়। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। 

৪. উভয় খাতের সহাবস্থান: এ অর্থব্যবস্থায় সরকারি - বেসরকারি খাত সহাবস্থান করে। দেশ ভেদে সরকারি - বেসরকারি খাতের তুলনামূলক গুরুত্ব ও আয়তন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তারা সহাবস্থানের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। 

৫. স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা: এ অর্থব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের মতো স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থার দ্বারা উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের কাজ সম্পন্ন হয়। চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়। ক্রেতার পছন্দ ও উৎপাদনকারীরবিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থির করা হয় দামের ওপর ভিত্তি করে। তবে জনস্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরকার দামের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়। তবে জনস্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরকার দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। 

৬. মুনাফা: মিশ্র অর্থব্যবস্থায় যেহেতু ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত, তাই ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকে সমর্থন করে। তবে একচেটিয়া কারবারের মাধ্যমে যেন অস্বাভাবিক মুনাফা না অর্জন করতে পারে সেদিকেও সরকার খেয়াল রাখে। 

৭. প্রতিযোগিতা: মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিখাতের প্রাধান্য থাকায় উৎপাদন ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা বিরাজ করে। তবে সরকার তার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ করে। 

৮. ভোক্তার স্বাধীনতা: এ ব্যবস্থায় ভোক্তা দ্রব্য ক্রয় - বিক্রয় ও ভোগের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে সামাজিক শৃঙ্খলা ও জরুরি প্রয়োজনে ভোক্তা স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 

৯. শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা: সরকারি খাতের শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের কাজের সময়, ন্যূনতম মজুরি, শিল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। 

১০. মুদ্রাস্ফীতি: ব্যক্তিগত উদ্যোগে উৎপাদনের স্বীকৃতি থাকায় মুনাফা বৃদ্ধিতে সরকারের বাধা থাকে না। ফলে অনেক সময় অধিক উৎপাদন আবার অনেক সময় কম উৎপাদন দেখা দেয়। ফলে এ অর্থব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি থাকে। অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কোনো ব্যবস্থাই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই অনেকে মিশ্র অর্থব্যবস্থাকে শ্রেষ্ঠ অর্থব্যবস্থা মনে করেন।

১১. মজুরি হার নির্ধারণ: মিশ্র অর্থনীতিতে সরকার শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি হার নির্ধারণ করে দেয়। বেসরকারি ও সরকারি খাতে শ্রমিকদের যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ মজুরি হার ভিন্ন হয়। এ অর্থনীতিতে শ্রমিক শোষণের মাত্রা কম।

১২. সামাজিক নিরাপত্তা: মিশ্র অর্থনীতিতে সরকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বেকার ও বয়স্ক ভাতা প্রদান, পেনশন গ্রাচুইটি ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সমস্যার সমাধান


মিশ্র অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার দুর্বলতা পরিহার করে সুবিধাগুলো সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন-

১. উৎপাদন পদ্ধতি: মিশ্র অর্থব্যবস্থায় কী দ্রব্য কোন পরিমাণে উৎপাদন হবে, কার জন্য উৎপাদন হবে, কীভাবে উৎপাদন হবে— এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি অবস্থান করে। রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে রেখে অন্যগুলো বেসরকারি বা ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

২. বণ্টন ও ভোগ: উৎপাদনের উপাদান ও সম্পদের উপর সরকারি ও বেসরকারি খাতের অবস্থান থাকার কারণে বন্টন ব্যবস্থাতেও উভয় খাতের কর্তৃত্ব লক্ষ করা যায়। যেমন- সরকারি উদ্যোগে যে বণ্টন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তার লক্ষ্য থাকে সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমিকের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আয় বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি।

অন্যদিকে, বেসরকারি বণ্টনের ক্ষেত্রে মুনাফাকে প্রধান উদ্দেশ্য বিবেচনা করা হয়। সুযোগ পেলেই পুঁজিপতিরা ভোক্তাকে জিম্মি করে অস্বাভাবিক মুনাফার চেষ্টা করে। তবে রাষ্ট্র মুনাফালোভী সিন্ডিকেট চক্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ভোগের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থায় ভোক্তা নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে, ধনতন্ত্রের ন্যায় এ অর্থব্যবস্থাতেও উৎপাদন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভোক্তার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url