ব্যবসায় অবস্থানের ধারণা ও গুরুত্ব
ব্যবসায় অবস্থান কাকে বলে?
ব্যবসায়ের অবস্থান বলতে যে স্থানে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় বা যে স্থান হতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। পরিচালনা করা হয় তাকে বুঝায়। প্রতিষ্ঠানের সফলতা বিশেষভাবে এর অবস্থানের উপর নির্ভর করে। তাই ব্যবসায় শুরুর পূর্বে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে অবস্থান নির্ণয় করতে হয়। গলির মাথায়, রাস্তার মোড়ে বা বাজারের প্রবেশ পথে মুদি দোকান যেভাবে জমে; গলির ভিতরে বা একটু পিছন দিকে সেভাবে তা জমে না। বন্দর গড়ে উঠার সাথে যেমনি পশ্চাদভূমির সম্পর্ক থাকে তেমনি ব্যবসায় গড়ে উঠার সাথে এর সন্নিহিত এলাকার বিভিন্ন উপাদানেরও সম্পর্ক রয়েছে।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্রেতাদের উপস্থিতির বিষয়টি যেমন বিবেচনা করা হয়; তেমনি কোনো স্থানে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হলে ঐ এলাকার শ্রমিক, কাঁচামাল, শক্তি সম্পদ, বাজার, যাতায়াত ইত্যাদি বিষয়গুলোর সুবিধাও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
ব্যবসায় অবস্থান বলতে এমন একটি জায়গা বা স্থানকে বুঝায় যে স্থানে ব্যবসায় স্থাপিত হলে ব্যবসায় পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপায়-উপাদান অতি সহজেই পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সাথে ক্রেতাদের সান্নিধ্য অতি সহজেই লাভ করা যায়। ব্যবসায় অবস্থানের কারণেই সারা বিশ্বে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের ব্যবসায় স্থাপন করতে দেখা যায়। যেমন:- সমূদ্র সৈকতে শামুক-ঝিনুকের দোকান, হাসপাতাল এলাকায় ঔষধের দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে বই, কাগজ-কলমের দোকান ইত্যাদি।
ব্যবসায় অবস্থান সম্পর্কে আগরওয়াল এবং জেইন বলেছেন,
কারখানা বা ব্যবসায়ের অবস্থান বলতে একটি উপযুক্ত স্থান নির্ধারণকে বুঝায় যেখানে কারখানা বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করবে।
এ সম্পর্কে আবার গোয়েল এবং গুপ্তা বলেছেন,
কারখানা বা ব্যবসায়ের অবস্থান বলতে বিশেষ কোনো স্থানে বিশেষ কোনো শিল্প ইউনিট বা ব্যবসায় স্থাপন করাকে বুঝায়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে ব্যবসায় অবস্থান সম্পর্কে যে ধারণাগুলো পাওয়া যায়; তা হলো
i. ব্যবসায় অবস্থান বলতে ব্যবসায়ের স্থানকে বুঝায়;
ii. এরূপ স্থান বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে;
iii. ব্যবসায়ের অবস্থান শহরে বা গ্রাম্য বা শিল্প এলাকায় হতে পারে
iv. ব্যবসায়ের উত্তম অবস্থান ব্যবসায়িক সফলতার পূর্বশর্তঃ
v. ব্যবসায়ের অবস্থান একই স্থানে কেন্দ্রীভূত হতে পারে; আবার নাও পারে।
পরিশেষে বলা যায়, যে স্থানে বা এলাকায় ব্যবসায় তথা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে বা যে স্থান হতে এসকল প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় তাকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বলে।
ব্যবসায় অবস্থানের গুরুত্ব | Importance of Business Location
ঢাকার আশে-পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠার যে বিপর্যয় এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অনেকেই বলছেন রপ্তানিমুখী এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য যেহেতু প্রায় ১০০% ই বিদেশে রপ্তানি হয় তাই এটা চট্টগ্রামে ব্যাপকভিত্তিতে গড়ে তুললে অসুবিধা কী ছিল?
ঢাকা শহরের ভয়ানক যানজট থেকে যেমনি মুক্ত হতো তেমনি মালামাল পরিবহন নিয়েও এত বিড়ম্বনা পোহাতে ও খরচ করতে হতো না। নিশ্চয়ই ঢাকার আশে-পাশে এ কারখানা গড়ার অবস্থানগত সুবিধা রয়েছে- যা চট্টগ্রামে নেই বা সেই ব্যবস্থা চট্টগ্রামে এখনও সৃষ্টি করা যায়নি। বিদ্যুৎ, রাস্তা-ঘাট, ব্যাংক ইত্যাদি অবকাঠামো সুবিধা বাদ দিলেও বিদেশী ক্রেতাদের নিরাপদে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়ার সুবিধা কতটুকু রয়েছে?
তাদের ক্রয় প্রতিনিধিরা উৎপাদনের মান নিশ্চিত করে বিদেশে পাঠাতে চায়। সেই বায়িং হাউজগুলো ঢাকাতে অবস্থান করে। সব বিচারে বিদেশী ক্রেতারা যেহেতু ঢাকাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে তাই ঢাকা এ শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হয়েই রয়েছে। তাই ব্যবসায়ে ভালো করতে হলে যথাযথ অবস্থানে ব্যবসায় গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সংক্ষেপে ব্যবসায় অবস্থানের গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধি (Increasing sale and profit): যথাস্থানে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হলে বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ বাড়ে। পণ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী ক্রেতারা সুবিধাজনক স্থান থেকে পণ্য পাওয়ার প্রত্যাশা করে। যেমন- চাল, ডাল, তেল, সাবান, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি পণ্য ক্রেতারা হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়ার প্রত্যাশা করে। তাই মহল্লায় ঢুকতে রাস্তার মোড়ে সাধারণত এরূপ পণ্যের ব্যবসায় গড়ে তোলা হয়। ক্রেতারা মার্কেটে গিয়ে কাপড়-চোপড় ঘুরে ফিরে দেখে কিনতে পছন্দ করে। তাই এরূপ দোকান শপিং সেন্টারে গড়ে ওঠে।
২. ক্রেতা সন্তুষ্টি বিধান (Gaining customer satisfaction): ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনের উপর ব্যবসায়িক সাফল্য নির্ভর করে। আর ব্যবসায়ের যথাযথ অবস্থান ক্রেতা সন্তুষ্টি বিধান সহায়ক। গ্রামের বাজারে ঢুকতে চায়ের দোকান লক্ষ্য করা যায়। কারণ ক্রেতারা বাজারে ঢোকার আগে বা পরে দোকানে বসে একটু চা খেয়ে গল্প অভাব করতে পছন্দ করে। বাস স্ট্যান্ডের পাশে ফলের দোকান থাকার কারণ হলো বাস থেকে নেমেই ক্রেতারা সহজে পণ্যটি সংগ্রহ করতে পারে। 'ওয়ালটন' তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য ডিলারদের শহরে বা গঞ্জের বড় রাস্তার পাশে দোকান খুলতে উৎসাহিত করে। এর অন্যতম কারণ হলো- গ্রামে-গঞ্জে অবস্থানরত ক্রেতারা যাতে এরূপ দোকান থেকে তাদের পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত হয়।
৩. সাফল্য লাভের অধিক সম্ভাবনা (More possibilities of gaining success): ব্যবসায়ে সফলতা অর্জনে এতদিকে যেমন দক্ষ পরিচালনা, উপযুক্ত পুঁজি, দক্ষ কর্মী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অন্যদিকে তেমনি যথাযথ। অবস্থান নির্ণয় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। যথাযথ অবস্থানে (Market place) এ ব্যবসায় গড়ে তুলতে না পারলে হাজারো চেষ্টা করেও ব্যবসায়ে ভালো করা যায় না। রেল স্টেশনের পাশে সাধারণ হোটেল, বিমান বন্দরকে টার্গেট করে ভালো মানের হোটেল এ কারণেই গড়ে তোলা হয়। অভিজাত এলাকায় দামী রেস্টুরেন্ট ও মহল্লার বাজারে চা-পুরির দোকান এ কারণেই গড়ে ওঠে। নিচ তলায় দোকান জমানো সহজ কিন্তু মার্কেটের উপর তলায় অনেক সময়ই গ্রাহক উঠতে চায় না। আবার প্রকৃতিগত ভাবেই সিলেটে চা শিল্প এ কারণেই গড়ে উঠেছে।
৪. স্থানীয়করণের সুবিধা অর্জন (Gaining facilities of localisation): ব্যবসায় স্থানীয়করণের বড় সুবিধা হলো একই স্থানে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি থাকায় ব্যবসায় পরিচালনা সুবিধা হয়। ঢাকা শহরের আশে-পাশে শ্রমিক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বজায় থাকার কারণে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠেছে। জেলা পর্যায়ে নিউমার্কেট বা বড় মার্কেটগুলোকে কেন্দ্র করে অনেক ছোট ছোট মার্কেট এ কারণেই গড়ে উঠতে দেখা যায়। টঙ্গী শিল্প এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠা, ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় দোকান প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ব্যবসায়ের আলাদা পরিচয় ও সুযোগ-সুবিধাও দান করে। এতে ব্যবসায়ের প্রচার সুবিধাও লাভ করা যায়।
৫. অবকাঠামোগত সুবিধা লাভ (Gaining infrastructural facilities): কার্যকর ব্যবসায় অবস্থান অবকাঠামোগত সুবিধা অর্জনেও ব্যবসায়কে সহায়তা করে। বিশেষ শিল্প এলাকায় শিল্প গঠনে অনেকের উৎসাহিত হওয়ার পিছনে বড় কারণ হলো- অবকাঠামোগত সুবিধা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জায়গা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি অবকাঠামোগত সুবিধা এখানে পাওয়া যায়। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্যই অবকাঠামো সুবিধা সম্বলিত ইপিজেড গড়ে তোলা হয়েছে। একটা মার্কেটে দোকান নিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত হওয়ার কারণ হলো- অবকাঠামোগত সুবিধা অর্জন। তাই এরূপ সুবিধা নেই এমন স্থানে কেউই শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। গড়তে স্বচ্ছন্দবোধ করে না।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায়িক সফলতার একটি অন্যতম উপাদান হলো- ব্যবসায়ের উত্তম অবস্থান। সঠিক স্থানে যদি ব্যবসায় স্থাপন করা যায়; তাহলে অন্যান্য বিষয়ের সামান্য ঘাটতি থাকলেও তেমন সমস্যা হয় না। তবে উপরোক্ত বিষয়গুলোতে ব্যবসায়ের উত্তম অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।