কৃষিপণ্যের বিপণন ও সমস্যা
যে সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য উৎপাদকের কাছ থেকে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় তাকে বিপণন বলে। এ অর্থে কৃষিপণ্যের বিপণন তথা বাজারজাতকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষি পণ্য উৎপাদন কারীদের কাছ থেকে চূড়ান্ত ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো হয়।
এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কর্মস্তর অতিক্রম করতে হয়। এগুলো হলো উৎপাদন শেষে পণ্য সংগ্রহ ও একত্রিকরণ, পণ্যের শ্রেণিবিভাগ ও নমুনাকরণ, প্যাকিং, গুদামজাতকরণ, মালিকানা বদল, পরিবহন অর্থসংস্থান, ঝুঁকি বহন, বিজ্ঞাপন প্রদান, বাজার সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ, বন্টন, বিক্রয় ইত্যাদি।
এগুলো সুষ্টভাবে সম্পাদিত হলে কৃষকরা পন্যের উপযুক্ত দাম পায় এবং ভোক্তা সাধারণও তা যথার্থ দামে ক্রয় করতে পারে। বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশে কৃষিপন্যের বাজার ব্যবস্থার নিজস্ব কতিপয় বৈশিষ্ট রয়েছে। এবং বাংলাদেশে কৃষিজাত পণ্যের বিক্রয় ব্যবস্থায় নিয়ে উল্লেখিত সমস্যা গুলো দেখা যায়।
বাংলাদেশে কৃষি পণ্য বিপণনে সমস্যাসমূহ
১. বাজারের অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ কৃষক বাজার সম্বন্ধে বিশেষ কোন খোজ-খবর রাখে না। বিভিন্ন কৃষি পণ্যের মূল্যের ভবিষ্যৎ গতি সম্বন্ধেও তারা ওয়াকিবহাল নয়। সুতরাং তাদের অজ্ঞতার জন্য মধ্যবর্তি ব্যবসায়ীগন অতিসহজেই কৃষকদেরকে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
২. দামের তীব্র উঠানামা: কৃষি পণ্যের দামের তীব্র উঠানামা ঘটে। ফসলের মৌসুমে দাম একেবারেই কম থাকে এবং মৌসুম শেষ হওয়ার পর দাম আবার বেশ বেড়ে যায়। কিন্তু যখন দাম বাড়ে তখন কৃষকের ঘরে আর কোন বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত থাকে না। সুতরাং দামের এরূপ তীব্র উঠানামার ফলে আমাদের কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৩. গুদামের অভাব: অধিকাংশ উন্নয়শীলদেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষি পণ্য সংরক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় গুদামের একান্ত অভাব রয়েছে। ফলে কৃষক সম্প্রদায় অধিক দাম পাওয়ার আশায় কৃষি পণ্য গুদামজাত করে রাখতে পারে না। তারা ফসলের মৌসুমে ফসল কম দামে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হয়।
৪. শ্রেণীবিভাগ ও নমুনাকরণের অভাব: স্বল্পোন্নত দেশসমুহে কৃষিপণ্য শ্রেণিবিভাগ ও নমুনাকরণের সুবন্দোবস্ত নেই। পণ্যের গুনাগুনের উপর এর দাম নির্ভর করে। কিন্তু এ সমস্ত দেশে পণ্যের গুণানুসারে তাদের শ্রেনিবিভাগ করা হয়না ফলে এখানে উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট পণ্য একই দামে বিক্রয় হয়। ফলে কৃষকরাও উৎকৃষ্ট পণ্যের জন্য ভালো দাম পায় না।
৫. কৃষকের দারিদ্র্য: দারিদ্র্যের জন্য কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য অধিক দাম পাওয়ার আশায় বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না। ফলে ফসল উঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক তার ফসল নাম মাত্র দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। আড়তদারগণ নামমাত্র মূল্যে এসব দ্রব্য খরিদ করে এবং পরে উচ্চ মূল্যে তা বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।
৬. পরিবহন ব্যবস্থার অভাব: বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশে পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে কৃষক কৃষি পণ্য দূরবর্তী বাজারে নিয়ে যেতে পারে না। ফলে নিকটবর্তি হাটবাজারে তারা কম দামে পণ্য বিক্রয় করতে বাধা হয়।
৭. দালালের প্রভাব: সাধারণত কৃষক তাদের পণ্য সরাসরি প্রকৃত ক্রেতাদের নিকট বিক্রয় করতে পারে না। প্রকৃত ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে একদল দালালশ্রেনীর লোক থাকে। মুনাফার প্রায় সবটুকু এ সমস্ত দালালদের হাতে চলে যায়।
৮. অশিক্ষা: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ সমূহের অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত ফলে তারা ফটকা কারবারের জটিলতা ও বৈদেশিক বাজারের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত।
৯. সংগঠিত বাজারের অভাব: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের গ্রামাঞ্চলের হাট বাজার সুনিয়ন্ত্রিত বা সুসংগঠিত নয়। নিয়ন্ত্রনের অভাবে বাজারে কৃষকদের নিকট থেকে বিভিন্ন হারে খাজনা আদায় করা হয়। বাজারের চাঁদা, আড়তদারি প্রভূত খাতে অর্থ প্রদান করার পর যে টাকা কৃষকের হাতে থাকে তা বস্তুত তার ফসলের ন্যায্যমূল্যের অর্ধাংশও নয়।
১০. পণ্যের মান: বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মান একরূপ নয়। ফলে কৃষি পণ্যের মান নির্ধারণের বিষয়টি কৃষিবাজারে এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে।
১১. সুষ্ঠু সরকারি নীতির অভাব: অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে কৃষি পণ্যের বাজার সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য সরকারের কোনরূপ সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে কৃষক কৃষি বাজারে রীতিমত অরাজক অবস্থা বিরাজ করে।
১২. প্রতিযোগীতার অভাব: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সুষ্ঠু যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে বাজার গুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে বিভিন্ন বাজারের মধ্যে প্রতিযোগীতার অভাব দেখা যায় এবং এক বাজারের সঙ্গে অন্য বাজারের দামের কোনরূপ সামঞ্জস্য থাকে না।
কৃষিপণ্যের বিপণন সমস্যা সমাধানে সরকারের ভূমিকা
বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের বিক্রয় ব্যবস্থা উন্নয়ন সাধনের উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহন করা যেতে পারে:
১. বাজার নিয়ন্ত্রন: বিভিন্ন বাজারে কৃষকদের নিকট থেকেই যাতে আড়তদারি, পাল্লাদারি, বিভিন্ন চাঁদা প্রভৃতি হতে অর্থ আদায় করতে না পারে সে জন্য আমাদের গ্রামঞ্চলে বাজারগুলোকে সুষ্টভাবে নিয়ন্ত্রন করা দরকার।
২. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি: দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরে কৃষি পণ্যের বহন খরচ হ্রাস করা দরকার। এছাড়া রাস্তাঘাটের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে গ্রামগুলোকে রেল স্টেশন ও স্টিমারের সাথে যুক্ত করতে হবে।
৩. শ্রেণীবিভাগ ও নমুনাকরণ: স্বল্পোন্নত দেশসমুহে কৃষিপণ্য শ্রেণিবিভাগ ও নমুনাকরণের সুবিধা আছে। পণ্যের গুনাগুনের উপর এর দাম নির্ভর করে। কিন্তু এ সমস্ত দেশে পণ্যের গুণানুসারে তাদের শ্রেনিবিভাগ করা হয়। ফলে এখানে উৎকৃষ্ট পণ্য ভালো দামে এবং নিকৃষ্ট পণ্য কম দামে বিক্রয় করতে পারবে। ফলে কৃষকও উৎকৃষ্ট পণ্যের জন্য ভালো দাম পাবে।
৪. গুদাম নির্মাণ ও কৃষি পণ্য সংরক্ষণ: গুদামজাতকরনের ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা যাতে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কম দামে তা বিক্রয় করে ফেলতে বাধ্য না হয় তার জন্য গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করে কৃষিপণ্য গুদামজাতকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. দালাল ও ফড়িয়ার বিলোপ সাধন: কৃষি পণ্যের বাজার থেকে দালাল ও মধ্যবর্তী ফড়িয়াদের বিলোপ সাধন করতে হবে। দালাল, ব্যাপারি, আড়তদার প্রমুখ মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীগন কৃষকদের প্রাপ্য মূল্যে ভাগ বসিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করে তোলে।
৬. কৃষি ঋণ: আর্থিক অনটনের ফলে আমাদের কৃষকের অধিক দাম পাওয়ার আশায় তাদের পণ্য সামগ্রী মজুত করে রাখতে পারে না। সুতরাং আর্থিক অনটনের জন্য কৃষক যাতে ফসলের মৌসুমেই পণ্য বিক্রয় করে দিতে বাধ্য না হয় সে জন্য উপযুক্ত কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. সর্বনিম্ন মূল্য ধার্যকরণ: সরকার কর্তৃক কৃষিপণ্যের যে সর্বনিম্ন মূল্য ধার্য করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেউ নির্দিষ্ট মূল্যের কম দামে ক্রয় করলে তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. ক্রয় এজেন্সি: ন্যায্য মূল্যে কৃষকদের নিকট থেকে ফসল ক্রয় করার উদ্দেশ্যে সরকারকে ক্রয় এজেন্সি গঠন করতে হবে। এ ধরনের ক্রয় এজেন্সির মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ফসল ক্রয় করলে অন্যরাও এ দামে ফসল ক্রয় করতে বাধ্য থাকবে।
৯. সমবায় বাজার সমিতি গঠন: বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের বাজারে অসংখ্য কৃষক বিক্রেতার বিপরীতে ক্রেতা হিসেবে স্বল্প সংখ্যক ফড়িয়া ও বেপারি থাকে। ফলে বাজারে একধরনের ওলিগোপসনি বিরাজ করে। এতে দরকষাকষির ক্ষেত্রে কৃষকের অবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ে ফলে তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। এমতাবস্তায় সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে বাজারে কৃষকদের অবস্থান শক্তিশালী করা দরকার।
১০. আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্তি সাধন: আমাদের কৃষি পণ্যের বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক সময় দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমে যাওয়ার আশংকায় খাদ্যশস্য রপ্তানি করা হয় না। এতে দেশে খাদ্য শস্যের মূল্য কম থাকে এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অতএব দেশের কৃষিপণ্যের বাজারে উন্নতি সাধনের জন্য দেশীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের মধ্যে সংযুক্তি সাধন দরকার।