ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থানের সুবিধা ও অসুবিধা
ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থানের সুবিধা | Advantage of Rural Location of Business
ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থান বলতে গ্রামীণ পরিবেশে ব্যবসায় গড়ে তোলাকে বুঝায়। প্রাচীন কাল থেকেই ছোট- ছোট বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ পরিবেশে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানকালে বড় বড় ব্যবসায় বা শিল্প প্রতিষ্ঠানও অনেকে গ্রাম্য অবস্থানে গড়ে তুলছে। এর পিছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান বা গ্রাম্য অবস্থানের। সুবিধাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো: ১. জমির কম দাম (Low price of land): বড় ধরনের ব্যবসায় বিশেষতঃ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অনেক জমির প্রয়োজন হয়। গ্রামে জমির দাম কম হওয়ায় জমি ক্রয়ে কম অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। ফলে ঐ অর্থ অন্যান্য সম্পদে বিনিয়োগ করে সহজেই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা যায়।
২. কাঁচামালের সহজলভ্যতা (Availability of raw materials): কাঁচামালের সহজলভ্যতার উপর অনেক ব্যবসায় তথা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন নির্ভরশীল। এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলে কমমূল্যে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ করা যায়।
৩. স্বল্পমূল্যে শ্রমিক প্রাপ্তি (Getting worker in low cost): উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শ্রম। তাই শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রম ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। গ্রামে জীবনযাত্রার ব্যয় কম হওয়ায় কম মূল্যে শ্রমিক সংগ্রহ সম্ভব হয়। তাই সাধারণ মানের শ্রমিক দিয়ে কাজ করা যায় এমন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গ্রাম্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করলে শ্রমিকের ব্যয় কম পড়ে। ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়।
৪. স্বাস্থ্যকর পরিবেশ (Heatlhy environment): খোলা-মেলা, আলো-বাতাসসমৃদ্ধ নিরিবিলি পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের শরীর ও মন-মনসিকতার উন্নতি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সকল স্তরের কর্মীরা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পায়। যা তাদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে।
৫. ঝামেলামুক্ত পরিবেশ (Trouble free environment): গ্রাম্য পরিবেশ নগর জীবনের বিভিন্ন জটিলতা, ঝামেলা ও কোলাহলমুক্ত। ধর্মঘট, হরতাল, যানজট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নগর জীবনকে যেভাবে বাধাগ্রস্ত করে গ্রামীণ পরিবেশে তার তেমন প্রভাব পড়ে না। এ জন্য শহর থেকে বাইরে গ্রামীণ পরিবেশে ব্যবসায় স্থাপনে অনেকে আগ্রহী হয়।
৬. করের সুবিধা (Tax facilities): শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ধরনের কর যেমন- পৌর কর, ভূমি কর, উন্নয়ন কর ইত্যাদি প্রদান করতে হয়। এ ছাড়াও বিদ্যুত, গ্যাস, পানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক হারে বিল আদায় করা হয়। গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে কম রাজস্ব দিতে হয়।
৭. সরকারের আর্থিক সহায়তা (Financial assistance of Govt.): দেশের সুষম উন্নয়ন এবং শহরাঞ্চলের মানুষের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে অনেক সময় সরকার গ্রামাঞ্চলে ব্যবসায় তথা শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করে। এজন্য সরকার এ অঞ্চলে বিশেষ ঋণ সুবিধা, নগদ সহায়তা প্রদান, কর রেয়াতসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে। এ ধরনের সুবিধাসমূহ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে।
৮. শ্রম ঘূর্ণায়মানতার নিম্ন হার (Low rate of labor-turnover): শহরাঞ্চলে একই স্থানে সমজাতীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকায় এক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অথচ গ্রামাঞ্চলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আধিক্য না থাকায় কর্মীদের শ্রম-ঘূর্ণায়মানতার এ সুযোগ থাকে না। ফলে কর্মীরা মনোনিবেশ সহকারে প্রতিষ্ঠানের কাজে সচেষ্ট হতে পারে।
৯. সম্প্রসারণের সুবিধা (Extension facilities): ব্যবসায়ের উন্নয়নের সাথে এর সম্প্রসারণ সম্পর্কযুক্ত। সম্প্রসারণের জন্য জায়গার প্রয়োজন পড়ে। শহরাঞ্চলে অনেক সময় অর্থ দিয়েও প্রয়োজনীয় জায়গা জোগাড় করা যায় না। অনেক সময় এখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ এত বেশি হয় যে এ ধরনের চিন্তা বাদ দিতে হয়। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের জায়গা প্রাপ্তির সুযোগ ও সেই সাথে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক কম হয়।
১০. শ্রম-ব্যবস্থাপনা সুসম্পর্ক (Good labor management relationship): প্রাণীণ পরিবেশ অনেকটা জটিলতামুক্ত। এছাড়া গ্রামীণ পরিবেশে ব্যবস্থাপক ও কর্মীগণ একত্রে কাজ করায় এবং সবার মধ্যে পারস্পরিক চেনা-জানা ও সহমর্মীতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় উত্তম শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বজায় থাকে। যা শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আশা করা যায় না।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায় অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। কোনো কোনো ব্যবসায় গ্রাম্য অবস্থানে সফলতা বয়ে আনে, আবার কোনো কোনো ব্যবসায় শহরে অবস্থানে সফলতা বয়ে আনে। তবে উপরোক ক্ষেত্রগুলোতে ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থান সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে বলে মনে করা হয়।
ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থানের অসুবিধা | Disadvantage of Rural Location of Business
গ্রাম্য অবস্থানের অনেক সুবিধার কথা বলা হলেও আমাদের মত দেশে এরূপ অবস্থানের অসুবিধার পরিমাণও কম নয়। ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থানের অসুবিধাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. দক্ষ শ্রমিকের অভাব (Lack of efficient worker): গ্রামে শ্রমিক সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে ঐ এলাকায় বসবাসরত মানুষের উপর নির্ভরশীল। দক্ষ ও যোগ্য-শ্রমিকরা অনেক সময় অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের আশায় শহরে পাড়ি জমায়। ফলে গ্রাম্য অবস্থানে অবস্থিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ দক্ষ শ্রমিকের অভাবে ভোগে।
২. বিপণন সংক্রান্ত সমস্যা (Problems relates with marketing): গ্রাম্য অবস্থানে বাজার স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকায় উৎপাদিত বা সংগৃহীত পণ্য বিপণনে সমস্যা হয়। ফলে দূরের বাজারে বা শহরাঞ্চলে তা নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। যে কারণে অনেকেই গ্রাম্য অবস্থানে ব্যবসায় গড়ে না তুলে শহরাঞ্চলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠায় উৎসাহবোধ করে।
৩. অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা (Undeveloped transportation and communication system): বৃহদায়তন ব্যবসায় তথা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে মালামাল আনা-নেয়াসহ বিভিন্ন কাজে ভাল পরিবহন সুবিধা থাকতে হয়। এ ছাড়া টেলিফোন, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে। গ্রাম্য অবস্থানে এখনও উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে তোলা যাচ্ছে না।
৪. সহায়ক প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি (Absence of auxiliary organisation): ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, মেরামত প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ নানান ধরনের সহায়ক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে। গ্রাম্য অবস্থানে এ ধরনের সহায়ক প্রতিষ্ঠানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে এরূপ অবস্থানে ব্যবসায় গড়তে অনেকেই নিরুৎসাহ বোধ করে।
৫. নিরাপত্তার অভাব (Lack of security): বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ব্যবসায় গঠনের উপযোগী নয়। গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গাতেই নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের উপদ্রব লক্ষ্য করা যায়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান দূরে থাকায় চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা অনেক সময় ব্যবসায়ীদের জিম্মী করে ফেলে। তাই এরূপ অবস্থায় কোনো ব্যবসায়ী নিজেকে নিপতিত করতে চায় না।
৬. স্থানীয় রাজনীতির অশুভ হস্তক্ষেপ (Harmful interference of local politics): স্থানীয় রাজনীতির অড প্রভাব অনেক সময় গ্রামাঞ্চলে কালো ছায়া বিস্তার করে। গ্রামাঞ্চলে সামান্য সমস্যায় রাজনৈতিক রং ছড়ানো হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে দলাদলি ও গণ্ডগোল জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে। তাই এরূপ স্থানে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কখনই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
৭. নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা (Insufficiency of urban facilities): গ্রামীণ জীবনে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা লক্ষ্য করা যায়। উন্নত রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি না থাকায় শিক্ষিত মানুষ গ্রামে থাকতে চায় না। যে কারণে বড় ব্যবসায় তথা শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগ্য কর্মীদের ধরে রাখা কষ্টকর হয়।
৮. শক্তি সম্পদের অভাব (Lack of energy facilities): গ্রামে-গঞ্জে শক্তি সম্পদের অপ্রাচুর্যতাও লক্ষণীয়। গ্যাস, বিদ্যুতসহ শক্তি সম্পদের অভাবের কারণেও এক্ষেত্রে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনেকেbআগ্রহী হয় না। বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতির মূল ভুক্তভোগী হলো গ্রামীণ জনপদ। গ্যাস সরবরাহ সর্বত্র না থাকায় ব্যবসায় গড়ে তোলা এখানে কষ্টকর।
৯. আর্থিক প্রতিবন্ধকতা (Financial hindrarences): গ্রামীণ পরিবেশে ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠান গড়ে না। উঠায় পুঁজি সংগ্রহে সমস্যা হয়। দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনে ব্যাংকের সহায়তা না পাওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ে। প্রত্যয় পত্র (LC) খোলার প্রয়োজন হলে তা সহজে খোলা যায় না। কর্মীরাও ব্যক্তিগতভাবে নানান আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ফলে বড় ব্যবসায় গ্রামে গড়ে তুলতে কেউ আগ্রহী হয় না।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায়ের গ্রাম্য অবস্থানের বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে এর অসুবিধাও লক্ষ্য করা যায়। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ অসুবিধাগুলো তেমন পরিলক্ষিত হয় না।