বাংলাদেশে পণ্য ডিজাইনে ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানের উপায় | How do you solve product design problems in Bangladesh

পণ্য ডিজাইন আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম কাজ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ কাজটি তত সহজ নয়। এ কাজের সাথে নানান ধরনের সমস্যা জড়িত। তবে সমস্যাকে সমস্যা মনে করে বসে থাকলে চলবে না। মুক্ত বাজার অর্থনীতির এ যুগে এ সকল সমস্যাকে মোকাবেলা করেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। বাংলাদেশে পণ্য ডিজাইনের সাথে জড়িত এসকল সমস্যা সমাধানের উপায় নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. ক্রেতা আচরণ নিরূপণ (Determine customer behavior): ক্রেতাদেরকে কেন্দ্র করেই পণ্য বা সেবার ডিজাইন করা হয়। তবে একেক ক্রেতা একেক ধরনের আচরণ করে। অর্থাৎ সকল ক্রেতা একই ডিজাইনের পণ্য ক্রয় করতে রাজি হয় না, যা আমাদের দেশে পণ্য ডিজাইনের অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ক্রেতাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী পণ্যের ডিজাইন করা উচিত।

২. প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংগ্রহকরণ (Procurement of necessary technology): আধুনিক ও মান সম্মত ডিজাইন প্রণয়নের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। কিন্তু সকল সময় ও সকল অবস্থায় পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে এ সকল প্রযুক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সময় গতানুগতিক পদ্ধতিতে পণ্যের ডিজাইন করা হয়, যা পণ্য ডিজাইনের অন্যতম সমস্যা বলে বিবেচিত হয়। একারণে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত প্রযুক্তি সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

৩. মূলধনের সংস্থান (Capital financing): আমাদের দেশে পণ্য বা সেবা ডিজাইনের ক্ষেত্রে মূলধনের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে। পণ্য ডিজাইনের জন্য বিশেষজ্ঞ ডিজাইনার নিয়োগ, প্রযুক্তি সংগ্রহ, প্রয়োজনীয় গবেষণা, বিদ্যমান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য প্রচুর পরিমাণে মূলধনের প্রয়োজন পড়ে। এরূপ প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে পণ্য ডিজাইন বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে সরকারসহ বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে মূলধনের সংস্থান করে এরূপ বাধা দূরকরণে ভূমিকা রাখতে হবে।
How do you solve product design problems in Bangladesh
৪. কাম্য মাত্রার উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার (Use of optimum level of production capacity): প্রতিষ্ঠান যদি উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদন কার্য পরিচালনা, করে তাহলে পণ্য ডিজাইনে নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। নতুন ডিজাইন করার ফলে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করার প্রয়োজন পড়ে, ফলে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখে নতুন পণ্য উৎপাদন করতে হয় অথবা কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। এ কারণে একেবারে কম বা একেবারে সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদন না করে কাম্য মাত্রায় উৎপাদন করা উচিত।

৫. চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বিধান (Adjustment with demand): পণ্য বা সেবার চাহিদা সর্বদা পরিবর্তনশীল। পণ্য বা সেবার চাহিদা খুব দ্রুত উঠা-নামা করলে পণ্য ডিজাইনে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমি চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরো প্রকট। তাই ক্রেতাদের চাহিদা পরিবর্তনের সাথে সাথে যাতে পণ্য ডিজাইনেরও পরিবর্তন করা যায় সেদিকে সামঞ্জস্য বিধান করে ডিজাইন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

৬. ক্রেতাদের রুচি ও ফ্যাশন পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য বিধান (Adjustment with change of taste and fashion of customers): ক্রেতাদের রুচি ও ফ্যাশন দ্রুত পরিবর্তনশীল। এরূপ পরিবর্তনশীল অবস্থায় পণ্যের ডিজাইন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায়ই দেখা যায়, যে ধরনের রুচি ও ফ্যাশনের কথা চিন্তা করে পণ্য বা সেবার ডিজাইন করা হয়, পণ্যটি বাজারে আসার পূর্বেই তা পরিবর্তিত হয়ে যায় অথবা বাজারে পণ্যটি আসার পর দ্রুত ক্রেতাদের রুচি ও ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়েছে। এরূপ অবস্থায় নতুন ডিজাইনকৃত পণ্যটির বাজার চাহিদা হ্রাস পায়। তাই ক্রেতাদের রুচি ও ফ্যাশন পরিবর্তনের সাথে পণ্যের ডিজাইন পরিবর্তনের সুযোগ (Provision) প্রভিশন রাখতে হবে।

৭. প্রশিক্ষণ দান (To provide training): আধুনিক ও রুচিসম্মত পণ্য ডিজাইন করার জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। কিন্তু নানান কারণে আমাদের দেশে পণ্য ডিজাইনে কর্মরত ডিজাইনারদের প্রশিক্ষণ প্রদান সম্ভব হয় না। তাই প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ডিজাইন করা সম্ভব হয়ে উঠে না, যা ডিজাইনের ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অথবা প্রয়োজনে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এ বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।

৮. দ্রুত বাস্তবায়ন (Quick implementation): পণ্য বা সেবার ডিজাইন মূলত পণ্য পরিকল্পনার একটি অংশ। কিন্তু এরূপ ডিজাইন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব থাকে অন্যকোনো কর্তৃপক্ষের উপর। তাই এক্ষেত্রে বাস্তবায়নে অনেক সময় অনীহা দেখা দিতে পারে। আবার ডিজাইন মোতাবেক পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, জনবল, কাঁচামাল, প্রযুক্তি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে প্রায়ই দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়ে, ফলে ডিজাইন বাস্তবায়নে ধীর গতি পরিলক্ষিত হয়, যা পণ্য ডিজাইনের একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়। তাই পরিকল্পিত ডিজাইনটি যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়; যে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

৯. পণ্য মূল্য বৃদ্ধি না করা (Not to increase product price): অনেকেই মনে করে, নতুন ডিজাইন মানেই পণ্য মূল্য বৃদ্ধি। এ কারণে ক্রেতারা নতুন ডিজাইনকৃত পণ্য ক্রয়ে অন্যগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে নতুন ডিজাইনকৃত পণ্যটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিক্রয় নাও হতে পারে। এ কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন প্রণয়নে অনেক সময় আগ্রহী হয় না, যা ডিজাইনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই পণ্য ডিজাইনের ফলে যাতে পণ্যের মূল্য অযথা বৃদ্ধি না পায় সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

১০. নকল প্রতিরোধ (Prevent adulteration): নতুন ডিজাইনকৃত পণ্য বাজারে আসা মাত্র প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো তা অনুকরণের চেষ্টা করে। ফলে যে প্রতিষ্ঠান অনেক চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা ও অর্থ বিনিয়োগ করে নতুন ডিজাইনের পণ্যটি বাজারে আনে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই পণ্যের নতুন ডিজাইন আবিষ্কারে নিরুৎসাহিত হয়। তাই নতুন আবিষ্কৃত ডিজাইনটি যাতে নকল না হয় সে দিকে সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, উপরে আলোচিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশে পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা পরিলক্ষিত হয়, তা অনেকাংশে সমাধান করা যাবে। তবে এ বিষয়গুলো একদিকে যেমন শুধুমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে সম্ভব নয়, অন্যদিকে তেমনি শুধুমাত্র সরকারের একার পক্ষেও তা সমাধান করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url