নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা

যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কাম্য উৎপাদন ক্ষমতাই কাঙ্ক্ষিত। তবে বিভিন্ন কারণে এ মাত্রার চেয়ে কম মাত্রায় পণ্য উৎপাদন করা হয়ে থাকে। যে কারণেই নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হোক না কেন তার কিছু কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা আছে। নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সুবিধাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সুবিধা Benefits of Under Utilization of Capacity


১. গুণগত মানের দিকে নজর প্রদান (Give attention to the quality): নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে পণ্যের গুণগত মানের দিকে যথাযথভাবে নজর দেওয়া যায়। কারণ অধিক সংখ্যক পণ্য উৎপাদন করা হলে অনেক সময় প্রতিটি পণ্যের মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

২. নির্দিষ্ট ক্রেতাদের সন্তুষ্টি লাভ (Achieving satisfaction of specific customers): পণ্যের উৎপাদন কম হলে বিক্রয় কম হয়। আর বিক্রয় কম মানেই- স্বল্প সংখ্যক ক্রেতা। তাই বলা যায়, নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে ক্রেতার সংখ্যা কম হয়। তাই এরূপ স্বল্প সংখ্যক ক্রেতার সন্তুষ্টি লাভে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। প্রত্যক্ষ সেবার ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।

৩. সহজ ব্যবস্থাপনা (Easy management): স্বল্প সংখ্যক উৎপাদন মানেই স্বল্প কর্মযজ্ঞ। আর যেখানে স্বল্প পরিমাণে কাজ সম্পাদন করা হয়, যেখানে ব্যবস্থাপনার কার্য পরিধিও কম হয়। স্বল্প পরিসরে ব্যবস্থাপনা কার্য সব সময়ই সহজ ও সাবলীল হয়। তাই বলা যায়, নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে ব্যবস্থাপনা সহজ ও সাবলীল হয়।

৪. ক্রেতাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক (Direct relation with customers): স্বল্প সংখ্যক পণ্য উৎপাদিত হলে বা স্বল্প পরিধিতে সেবা প্রদান করা হলে ক্রেতা বা সেবা গ্রহীতাদের সাথে উৎপাদক বা সেবাদাতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর ক্রেতাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি সম্পর্ক গড়ে উঠা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলকর।

৫. গবেষণা ও উন্নয়নে মনোনিবেশ (Attention to research & development): স্বল্প পরিসরে পণ্য উৎপাদন করা হলে কর্তৃপক্ষের হাতে যথেষ্ট সময় থাকে। এক্ষেত্রে তারা পণ্য উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারে। আর পণ্য গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

৬. স্বল্প মূলধনের ব্যবহার (Use of low capital): নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূলধনের পরিমাণ কম লাগে। কারণ স্বল্প উৎপাদনের জন্য একদিকে যেমন স্বল্প পরিমাণ কাঁচামালের প্রয়োজন হয় অন্যদিকে তেমনি শ্রমিকের সংখ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ের ব্যবহারও কম হয়। তাই এক্ষেত্রে স্বল্প পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন পড়ে।

৭. কর্মীদের অযথা চাপ হ্রাস (Reducing additional presure of the workers): নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে কর্মীদের অযথা চাপ হ্রাস পায়। মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন করা হলে কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক চাঁপ বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের কর্মদক্ষতা হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন করা হলে তাদের অতিরিক্ত চাপ হ্রাস পেয়ে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

৮. উত্তম শিল্প সম্পর্ক রক্ষা (Keeping good industrial relations): প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে উত্তম শিল্প সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্য সম্পাদিত হলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রতিটি বাক্তিন মধ্যে এমনকি ক্রেতাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়। ফলে তাদের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে।

৯. উত্তম কার্য পরিবেশ সৃষ্টি (To create good working environment): স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্য সম্পাদিত হলে উত্তম কার্য পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন থাকে যা উত্তম কার্য পরিবেশ সৃষ্টি ও রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

১০. ব্যবসায় সম্প্রসারণের চিন্তা-ভাবনা (Thinking about business expansion): নিম্নমাত্রায় উৎপাদন কার্যক্রম চালানো হলে ভবিষ্যতে ব্যবসায় সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করা যায় এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। আবার স্বল্প উৎপাদনের ফলে মান সম্মত পণ্য উৎপাদন করাও সম্ভব হয়, যা ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক। আর ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলে ব্যবসায় সম্প্রসারণের বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

পরিশেষে বলা যায়, নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত না হলেও এর ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপরোক্ত সুবিধাগুল্যে অর্জিত হয়। তবে এসুবিধাগুলোর আশায় দীর্ঘমেয়াদে স্বল্প উৎপাদন করা কোনো অবস্থাতেই সুখকর বলে বিবেচিত হয় না।

নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সমস্যা |Problems Arising from Under Utilization of Capacity


নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের ফলে যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা অর্জিত হয়, তবুও এর অসুবিধাও কিন্তু কম নয়। নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতার অসুবিধা বা সমস্যা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. স্বল্প বিক্রয় (Low sales): নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়। আর উৎপাদন হ্রাস পেলে বিক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস পায়।

২. একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি (Increasing per unit production cost): স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন কার্য সম্পাদিত হলে একক প্রতি স্থায়ী ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সামগ্রিকভাবে একক প্রতি মোট উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি হয়।

৩. স্বল্প মুনাফা (Low profits): নিম্ন উৎপাদন স্বল্প বিক্রয়কে নির্দেশন করে। আর স্বল্প বিক্রয়ের ফলে একদিকে যেমন মোট মুনাফা হ্রাস পায়, অন্যদিকে তেমনি একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েও মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায়।

৪. কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি (To create unrest among the employees): স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা অনেক সময় কর্মী অসন্তোষের কারণ হতে পারে। স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হলে কর্মীরা মনে করে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থা ভাল না। তাই তারা অসন্তোষ নিয়ে কাজ করে যা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলকর নয়।

৫. নেতিবাচক মনোভাব (Negative attitude): স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা হলে প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষ মনে করে- প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থাসহ সামগ্রিক অবস্থা ভাল না। আর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিভিন্ন পক্ষের এরূপ নেতিবাচক মনোভাব প্রতিষ্ঠানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

৬. শ্রম ঘূর্ণায়মানতা (Labor turnover): শ্রম ঘূর্ণায়মানতা হলো কর্মীদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা। প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিকরা যদি একের পর এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যায়, তাহলে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অন্যান্যদের ঋণাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হয়।

পরিশেষে বলা যায়, নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের ফলে উপরোক্ত সমস্যা বা অসুবিধাগুলোর সৃষ্টি হয়। তাই যে কোনো প্রতিষ্ঠানের উচিত সকল সময় কাম্য মাত্রায় উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url