বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার সমস্যা
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশ। এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু সমস্যা বিদ্যমান। উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এদেশে বেশ কিছু সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা বিদ্যমান তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. পেশা হিসেবে স্বীকৃতির অভাব (Lack of recognition as a profession): পেশা হিসেবে উৎপাদন ব্যবস্থাপকের প্রথাসিদ্ধ স্বীকৃতি বাংলাদেশে নেই। এদেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের দেশের আইন অনুযায়ী পেশা হিসেবে যেরূপ স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেরূপ স্বীকৃতি উৎপাদন ব্যবস্থাপকদের দেওয়া হয় না ফলে এ পেশায় সাধারণত তেমন কেউ আসতে চায় না।
২. অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থাপক (Inefficient production manager): আমাদের দেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অদক্ষতা একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার একটি বিশেষায়িত শাখা হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা জ্ঞান বহির্ভূত ব্যক্তিও নিয়োগ পেয়ে থাকে। আর ব্যবস্থাপনার জ্ঞান শূন্য ব্যক্তিদের বিশেষায়িত এরূপ একটি ক্ষেত্রে নিয়োগদানের কারণে অদক্ষতার সৃষ্টি হয়।
৩. ডিজাইন নির্ধারণে সমস্যা (Problems in determining design): উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম কাজ হলো পণ্যের ডিজাইন প্রণয়ন করা। যদিও কখনও কখনও পণ্যের নকশা প্রণয়নের জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, তবুও চূড়ান্ত নকশার অনুমোদন তাকেই দিতে হয়। কিন্তু বাজার গবেষণা, পণ্যের মান, প্রতিযোগিতা, মূল্য ইত্যাদি বিবেচনা করে বাস্তব সম্মত ডিজাইন প্রণয়ন করা অনেক সময়ই সম্ভবপর হয়ে উঠে না।
৪. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training): বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এদেশে প্রযুক্তি নির্ভর কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের, সীমিত পর্যায়ে কৃষকদের বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে কোনোরূপ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। তাই প্রশিক্ষণের অভাবে এদেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌছাতে পারেনি।
৫. উন্নত প্রযুক্তির অভাব (Lack of developed technology): উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার যে কোনো উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আমাদের দেশে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব লক্ষ্য করা যায়। মূলধনের অভাব, কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন কর্মীর অভাব, শ্রম অসন্তোষ ইত্যাদি কারণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। এদেশে এখনও মেয়াদ উত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
৬. বাস্তবসম্মত উৎপাদন পরিকল্পনার অভাব (Lack of real production plan): উৎপাদন পরিকল্পনার আওতায় থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে তার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়। তাই এরূপ পরিকল্পনা যত বাস্তবসম্মত হবে ব্যবস্থাপনা কার্যের ফলপ্রসূতাও ততই বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্যান্য পরিকল্পনার ন্যায় উৎপাদন পরিকল্পনাও ততটা বাস্তবসম্মত হয় না। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৭. অপরিকল্পিত বিন্যাস ব্যবস্থা (Unplanned layout system): সঠিক ও বাস্তবসম্মত বিন্যাস ব্যবস্থা উৎপাদন ব্যবস্থাপনার কাজের গতিতে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নানান কারণে বাংলাদেশে কারখানা বিন্যাস মানসম্মত ও বাস্তবসম্মত হয় না। এতে কার্য সম্পাদনে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নানান ধরনের সমস্যায় পড়ে। সম্প্রতি 'রানা প্লাজা ট্রাজেডি', 'তাজরিন ফ্যাশন' ও 'সেজান জুস' কারখানায় দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য শিল্প কারখানায় যে সকল দুর্ঘটনা লক্ষ্য করা যায়, তার অন্যতম কারণ ছিল অপরিকল্পিত বিন্যাস ব্যবস্থা।
৮. মান নিয়ন্ত্রণে সমস্যা (Problem in quality control): বর্তমান উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পণ্যের মান ঠিক রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কারণে যদি পণ্য মানের অবনতি হয়, তাহলে ঐ পণ্য বা প্রতিষ্ঠান হতে ক্রেতারা অতি সহজেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মান নিয়ন্ত্রণের এ কাজটি উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম কাজ হিসেবে বিবেচিত হলেও এর জন্য যেরূপ ডিভাইসের প্রয়োজন তা বাংলাদেশে নেই।
৯. ত্রুটিপূর্ণ মওজুদ নিয়ন্ত্রণ (Faulty inventory controlling system): মওজুদ পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা উৎপাদন ব্যবস্থাপনার আরেকটি অন্যতম কাজ। কারণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অধিক পণ্য মওজুদ থাকলে একদিকে যেমন অপচয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে কম পণ্য মওজুদ থাকলে বাজারে পণ্যের ঘাটতি পড়তে পারে। তাই মওজুদের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে রাখতে তা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে পণ্য মওজুদ করার মত পর্যাপ্ত টেকনোলজি না থাকায় উৎপাদন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হয়।
১০. সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের অভাব (Lack of cordial relationship): যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাঙ্কিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মীর মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানে এরূপ সম্পর্কের অভাব লক্ষ্য করা যায়। শ্রমিক সংঘের অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ, মালিক পক্ষ ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস, প্রেষণার অভাব ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের অভাব লক্ষ্য করা যায়। সেবামূখী প্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব পরোক্ষ হলেও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব সরাসরি।
১১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political instability): বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিষয়টি লক্ষণীয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এদেশে অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পও ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে এসে পৌছিয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঋণাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক কারণে প্রায়ই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকে, ফলে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য অর্জিত হয় না।
১২. উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা (Problem in production control): উৎপাদন পরিকল্পন। উৎপাদন নিয়ন্ত্রণও উৎপাদন, ব্যবস্থাপনার আরেকটি অন্যতম কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদন পরিকল্পনার ন্যায় উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তব সম্মত উৎপাদন পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে উৎপাদন পরিকল্পনাই যেখানে ত্রুটিপূর্ণ সেখানে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। তাই উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের সমস্যাও উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম অসুবিধা হিসেবে বিবেচিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও আমাদের দেশে এ ব্যবস্থাপনার সমস্যা কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সমস্যা, শ্রম অসন্তোষ, মূলধনের অভাব, মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।