জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব | Importance of Measurement of National Income

আয় বুঝে ব্যয় করা বা ব্যয় বুঝে আয় করা-এ দুটোর কোনোটার সাথে মিলিয়ে চলতে পারেন না মি. মুবিন। ব্যবসায়ে যখন আয় হয় তখন তিনি দু'হাতে খরচ করেন কিন্তু যখন মৌসুমি কারণে ব্যবসায়ে দুর্দিন বা মন্দাভাব থাকে তখন আর খরচ কমাতে পারেন না। ফলে ঋণ করে চলেন। এভাবে চলতে চলতে এখন তার ব্যবসায় অচল হওয়ার উপক্রম। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন তার প্রতি হতাশ। এখন কেউ ঋণ দিতেও চায় না। এক্ষেত্রে মি. মুবিনের সমস্যা হলো তার আয় কখন কী অবস্থায় থাকে তার সাথে সঙ্গতি বিধান করে চলার ব্যর্থতা।

ব্যক্তির জন্য এটা যেমন সমস্যা তেমনি একটা জাতির জন্য এ সমস্যা আরও বেশি। সব দেশ যখন জাতীয় আয় হিসাব করে চলে তখন একটা দেশ যদি তা হিসাব না করে চলতে থাকে তবে ঐ দেশের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে না দেশের মানুষ জানতে পারবে, না অন্যান্য দেশ, দাতা সংস্থা উক্ত দেশ সম্পর্কে জেনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, নির্দেশনা ও সহযোগিতা করতে সমর্থ হবে। তাই আজকের দিনে, জাতীয় আয় পরিমাপ না করে এমনি এমনি চলার সুযোগ নেই। জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্ব
১. অর্থনৈতিক অবস্থার মানদণ্ড (Standard of economic condition): জাতীয় আয় হলো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠি। একটা দেশের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদন, মোট জাতীয় উৎপাদন, নিট জাতীয় উৎপাদন, মোট ভোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি বাড়ছে না কমছে সেই সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা জাতীয় আয় পরিমাপের মাধ্যমে জানা যায়।

এতে বিভিন্ন খাতের মধ্যে যেমনি তুলনা করা যায় তেমনি জীবনযাত্রার মান, মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রা সংকোচন পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কেও জানা যায়। সব মিলিয়ে প্রতিটা, দেশেই জাতীয় আয় পরিমাপ ঐ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে।

২. তথ্য প্রাপ্তি (Receiving information): জাতীয় আয় পরিমাপ করতে গেলে স্বভাবতই মোট দেশজ উৎপাদন, মোট জাতীয় উৎপাদন, নিট জাতীয় উৎপাদন, অবচয়জনিত ব্যয়, ভোগ, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় খরচ, খাজনা, কর ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়। এ সকল তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ থেকে সরকার একদিকে যেমন এ সম্পর্কে তথ্য পায় এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা নিতে পারে অন্যদিকে তেমনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও দেশের উৎপাদন, ভোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদির গতি-প্রকৃতি বুঝে সেভাবে সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে সামর্থ্য হয়। বিভিন্ন সংস্থাও তাদের গবেষণার কাজে এ সকল তথ্য ব্যবহার করতে পারে।

৩. সঠিক কর্মপন্থা বা পরিকল্পনা নির্ধারণ (Determining proper course of action or plan): মোট জাতীয় উৎপাদন বের করতে গেলে বিভিন্ন খাতের উৎপাদন অবস্থা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়। জাতীয় আয় পরিমাপে কৃষি, শিল্প, সেবা, বিদেশে অবস্থানরত জনশক্তি থেকে আয়, রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয় ইত্যাদি বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর অবস্থা বিবেচনায় নিলে প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক বোঝা যায়। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে কোন খাতের কতটা অবদান, প্রবৃদ্ধিকে দ্রুততর করতে কোন কোন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত সে সম্পর্কেও তথ্য লাভ করা যায়। এ সকল তথ্য বিবেচনা করে সরকার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সঠিক কর্মপন্থা বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারে।

৪. প্রতিযোগিতার মনোভাব উন্নয়ন (Developing competitive attitude): ব্যক্তির মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হলে তা একদিকে যেমন তাকে কর্মক্ষেত্রে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগায় অন্যদিকে তেমনি একটা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতার মনোভাব ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশকে উদীয়মান ব্যাঘ্র বলা হচ্ছে। এটা শুনতে ভালো লাগে। আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বিগত বছরগুলোতে ৫% এর উপরে-এটা শুনলে আরো ভাল লাগে। কারণ ইউরোপের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি যখন ২% থেকে ৩% এর মধ্যে তখন আমাদের প্রবৃদ্ধির হার তার চেয়েও বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশে জনগণের মাথাপিছু আয় ২,২২৭ মার্কিন ডলার যা ২০১৯-২০২০ সালে ছিল ২০৬৪ মার্কিন ডলার। এভাবে সকল তথ্য বিবেচনায় নিলে এবং সেই সাথে। প্রতিযোগী দেশগুলোর অবস্থা বিবেচনা করলে জাতীয়ভাবে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।

৫. আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ (Draw international attention): জাতীয় আয় পরিমাপ একটা দেশকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণেও সহযোগিতা করে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেপলেপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদি দাতা প্রতিষ্ঠান ঋণ বা আর্থিক সহযোগিতার পূর্বে একটা দেশের জাতীয় আয়, মোট জাতীয় উৎপাদন, নিট জাতীয় উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চায়। যদি তারা দেখে দেশটি সম্ভাবনাময় এবং সামনের দিকে এগুনোর সম্ভাবনা বিদ্যমান তখন তারা ঋণ দিতে উৎসাহিত হয়। তারা প্রদত্ত ঋণের ফলাফলও বুঝতে চায়। একইভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এ ধরনের তথ্য জেনে একটা দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়।

পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের জনগণের আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, জীবযাত্রার মান ইত্যাদি পরিমাপ করার জন্য একদিকে যেমন জাতীয় আয় পরিমাপের প্রয়োজন পড়ে, অন্যদিকে তেমনটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতির সাথে স্বীয় দেশের অর্থনীতির তুলনাকরণের জন্যও জাতীয় আয় পরিমাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url