উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপের পদ্ধতি | Method of Measuring Production Capacity
কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তার সম্পদ ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ পণ্য বা সেবা উৎপাদন করে তাই হলো- উৎপাদন ক্ষমতা।
বিভিন্নভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ করা যায়। তবে যে পদ্ধতিতেই উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ করা হোক না কেন এটি পরিমাপ করা অত্যন্ত জরুরি।
কারণ উৎপাদন ক্ষমতার উপর অনেক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ সম্পর্কে বলা যায়, যে প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় তাকে উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাপ বলে।
তুমি যদি কোনো ফটোকপিয়ার দোকানে জিজ্ঞাসা কর, আপনার ফটোকপিয়ার মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা কত? তিনি হয়তো বলবেন, মিনিটে ১০০ কপি।
আবার যদি কোনো থিয়েটার মালিককে জিজ্ঞাসা কর, তবে তার উত্তরে হয়তো তিনি বলবেন, এক সাথে ৫০০ জন লোক বসা যায়। অন্যদিকে কোনো কম্পিউটার সফ্টওয়ার কোম্পানিকে জিজ্ঞাসা করলে, তারা হয়তো বলবে স্টোরিং ক্যাপাসিটি ৫০০ জিবি।
তাই দেখা যায়, সকল পরিস্থিতিতে উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপে কোনো একক পরিমাপককে ব্যবহার করা যায় না। এক্ষেত্রে একেক ধরনের প্রতিষ্ঠান একেক ভাবে তাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে পরিমাপ করে।
তবে যে যেভাবেই তাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে পরিমাপ করুক না কেন মোটামুটিভাবে দুইটি বিষয়কে ভিত্তি ধরে তা নির্ধারণ করা হয়, যাদের একটি হলো- উৎপাদিত পণ্যের (Output) ভিত্তিতে এবং অন্যটি হলো ব্যবহৃত উপকরণের (Input) ভিত্তিতে। উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাপের এ দু'টি পদ্ধতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
উৎপাদিত পণ্যের ভিত্তিতে | Measures on the basis of output
উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপে এ পদ্ধতিটি সাধারণত বড় বড় প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিক পরিমাণ কিন্তু একই ধরনের পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। যেমন: নিশান মটরস তাদের উৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে বলতে পারে বাৎসরিক ৪,৫০,০০০টি গাড়ি। আবার টাটা কোম্পানি হয়তো বলবে বাৎসরিক ১০,০০,০০০ টি ট্রাক ইঞ্জিন।
এ পদ্ধতিটি শুধুমাত্র একই ধরনের পণ্য উৎপাদন বা সেবাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী। যদি একই সাথে নানান ধরনের পণ্য উৎপাদন করা হয়, অথবা একাধিক প্রকারের সেবা দান করা হয় তাহলে উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণের এ পদ্ধতিটি সীমিত হয়ে পড়ে।
যেমন: কোনো রেস্টুরেন্ট যদি ঘন্টায় শুধুমাত্র ১০০ জন সেই ধরনের ক্রেতাকে খাবার সরবরাহ করতে পারে, যারা রেস্টুরেন্টে বসে খায় না (Take-out coustomer), অথবা মাত্র ৫০ জন ক্রেতাকে খাবার সরবরাহ করতে পারে, যারা রেস্টুরেন্টে বসে খায় (Sit-down cust customer)।
আবার যদি বলা হয়, রেস্টুরেন্টটি একই সাথে ৭৫ জন টেক-আউট কাস্টমারকে এবং ২৫ জন সিট-ডাউন কাস্টমারকে খাবার সরবরাহ করতে পারে, এরূপ বিভিন্ন পণ্য বা সেবা মিশ্রণে (Product mix) উৎপাদিত পণ্যের ভিত্তিতে উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ করা বেশ জটিল।
যে সকল প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক স্বল্প সংখ্যক এবং নির্ধারিত মানের পণ্য বা সেবা সরবরাহ করে অথবা একটি মাত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে সে সকল প্রতিষ্ঠান উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণে এ পদ্ধতিটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে।
ব্যবহৃত কাঁচামালের ভিত্তিতে | Measures on the basis of output
কোনো পণ্য উৎপাদনে যে পরিমাণ কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তাকে ব্যবহৃত কাঁচামাল বলে। উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণের এ পদ্ধতিটি ছোট- খাটো এবং নমনীয় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মেশিন ঘণ্টা বা মেশিনের সংখ্যার সাহায্যে একটি ফটোকপির দোকান তাদের উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারে।
যেখানে পণ্য মিশ্রণ (Product mix) অথবা উৎপাদিত পণ্য (Output) ক্ষমতা পরিমাপে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, সেখানে চাহিদাকে ইনপুট পরিমাপে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে চাহিদাকে আউটপুট রেট ধরে তাকে ইনপুটে রূপান্তর করা হয়। এভাবে চাহিদাকে ইনপুটে রূপান্তর করে তবেই উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণ করা যায়।
যেমন: একজন ফটোকপি সেন্টারের ম্যানেজার তার সেন্টারের বাৎসরিক মোট চাহিদার ভিত্তিতে কয়টি মেশিনের প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করতে পারেন। ধরা যাক, বাৎসরিক ৫ লক্ষ ফটোকপির চাহিদা আছে। কিন্তু একটি মেশিনের বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লক্ষ কপি।
এক্ষেত্রে এরূপ অবস্থায় উৎপাদন ক্ষমতা হবে বে দু'টি মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতার সমান। অর্থাৎ বাৎসরিক ৫ লক্ষ ফটোকপির চাহিদা পূরণে তাকে অবশ্যই দু'টি ফটোকপিয়ার মেশিন ক্রয় করতে হবে যা হবে তার উৎপাদন ক্ষমতা।
উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপের সাথে জড়িত ধারণাসমূহ Concepts Related to Measure of Production Capacity
কোনো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের উৎপাদনের ক্ষমতা পরিমাপ করতে পারে। এটি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতির উপর। তবে যেভাবেই উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ করা হোক না কেন, তা পরিমাপের সাথে কতকগুলো ধারণা জড়িত। উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপের সাথে জড়িত এ সকল ধারণা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার | Utilization of production capacity
একটি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের ফলে যদি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সকল উপাদানের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত হয়, তবে তাকে উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার বলে। উৎপাদন ক্ষমতা পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রক্রিয়ার চলতি উৎপাদন এবং এর সদ্ব্যবহার (Utilization) সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
সদ্ব্যবহার (Utilization) বলতে 'যন্ত্রপাতি, স্থান, এবং শ্রম শক্তি ব্যবহারের হারকে বুঝায়। অর্থাৎ উৎপাদনে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি, স্থান এবং শ্রম ব্যবহারের শতকরা হারকে সদ্ব্যবহার বলে। নিম্নোক্ত সূত্রের সাহায্যে সদ্ব্যবহারকে প্রকাশ করা যায়:
✓উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার (সর্বোচ্চ) = গড় উৎপাদনের হার × ১০০÷সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা
✓উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার (কার্যকর) = গড় উৎপাদনের হার × ১০০÷কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা
এক্ষেত্রে গড় উৎপাদন হার এবং উৎপাদন ক্ষমতাকে একই শব্দে (Terms) অর্থাৎ সময়, ক্রেতার সংখ্যা, উৎপাদন একক অথবা টাকায় পরিমাপ করতে হয়। সদ্ব্যবহার (Utilization), বর্তমান ক্ষমতার চেয়ে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ক্ষমতা যোজন অথবা বর্তমান ক্ষমতা অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতা বিয়োজনকে নির্দেশ করে।
তবে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন, অথচ এর উপরই উৎপাদন ক্ষমতা সদ্ব্যবহারের বিষয়টির নির্ধারণ নির্ভর করে। এ কারণে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা এবং কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা বিষয়ে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা| Peak capacity
আদর্শ পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ যে পরিমাণ পণ্য বা সেবা উৎপাদন করা যায়, তাকে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা বলে। যখন শুধুমাত্র যন্ত্রপাতির আলোকে উৎপাদন ক্ষমতা নিরূপণ করা হয়, তখন তাকে হারকৃত ক্ষমতা (Rated capacity) বলে।
সাধারণত সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা দীর্ঘ মেয়াদে বহাল থাকে না। এটি খুবই স্বল্প সময়ের জন্য অর্থাৎ একটি দিনের কয়েক ঘণ্টার জন্য অথবা মাসের একটি দিন বা কয়েক দিনের জন্যও ঘটতে পারে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে অতিরিক্ত সময় (Overtime), অতিরিক্ত শিফ্ট (Extra shift), এবং খণ্ডকালীন কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হতে পারে।
যেহেতু খুবই স্বল্প সময়ের জন্য এগুলো করা হয়, তাই দীর্ঘ সময়ে এরূপ সাহায্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিকরা খুব বেশি সময় ধরে ওভার টাইম করতে চায় না, আবার নাইট শিফ্ট চালু করলে একদিকে যেমন ব্যয় বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে তেমনি কর্মীদের কর্ম দক্ষতাও হ্রাস পেতে পারে। নিম্নের সূত্রের সাহায্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা নির্ণয় করা যায়:
✓উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার (সর্বোচ্চ) = গড় উৎপাদনের হার × 100 ÷ সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা
কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা | Effective capacity
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মিতব্যয়িতার সাথে কোনো প্রক্রিয়ার বা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ উৎপাদনই হলো কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা। কোনো প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র একটি শিফ্ট চালুর মাধ্যমে মিতব্যয়িতা অর্জন করতে পারে, আবার দু'তিনটি শিফ্ট চালুর মাধ্যমেও তা অর্জন করতে পারে।
এক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা অর্জন করতে হবে এটিই বড় কথা। আর উৎপাদনে মিতব্যয়িতা অর্জিত হলে অর্থনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ লাভজনক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। নিম্নের সূত্রের সাহায্যে কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা নির্ণয় করা যায়:
✓উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার (কার্যকর) = গড় উৎপাদনের হার × ১০০ ÷ কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা
সর্বোচ্চ ক্ষমতা বৃদ্ধি (Increasing maximum capacity
অনেক সময় একই সাথে একাধিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা হয়। এরূপ অবস্থায় প্রতিটি প্রক্রিয়ার উৎপাদন ক্ষমতাও একইরূপ হয় না। তাই সামষ্টিকভাবে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি একটি জটিল বিষয় হয়ে পড়ে।
ফলে ব্যবস্থাপনার জন্য উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাপ এবং উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি সংগ্রহ করে এবং নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়।
আবার কর্ম ঘণ্টা বৃদ্ধি করে অথবা প্রক্রিয়াকে পুনঃবিন্যাস করেও এরূপ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। তবে কিভাবে উৎপাদন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে, তা ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করবেন।
সিস্টেম দক্ষতা | System efficiency
কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্যকর উৎপাদন ক্ষমতা এবং প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতার অনুপাতকেই সিস্টেম দক্ষতা বলে। এটি শতকরা হারে প্রকাশ করা হয়।
সদ্ব্যবহার দক্ষতাকে অনেক সময় সিস্টেম দক্ষতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে সিস্টেম দক্ষতার ধারণাটি একটি তাৎক্ষণিক ধারণা। নিম্নোক্ত সূত্রের সাহায্যে সিস্টেম দক্ষতা নির্ণয় করা হয়-
✓সিস্টেম দক্ষতা = প্রকৃত উৎপাদন × ১০০ ÷ সিস্টেম / কার্যকর দক্ষতা