জাতীয় আয় পরিমাপের সমস্যাসমূহ | Problems of National Income Measurement

জাতীয় আয় পরিমাপে একটা দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন, নিট জাতীয় উৎপাদন, উৎপাদিত সামগ্রীর আর্থিক মূল্য নিরূপণ, পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতির বিচারে খাজনা, মজুরি, মুনাফা, কর, ভোগ, বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি, অবচয় ইত্যাদি নানান বিষয় নিরূপণের প্রয়োজন পড়ে।

একজন ব্যক্তির বেলায় যদি তিনি শুধুমাত্র চাকরি করেন তবে সেটার হিসাব অনেক সহজ। কিন্তু তিনি যদি চাকরির সাথে কিছু ব্যবসায় বা অন্য কাজ করেন তবে আয় হিসাব করা একটু জটিল হয়ে দাঁড়ায়। একটা জাতির মানুষের সব আয় হিসাব করে জাতীয় আয় বের করার বিষয়টা কতটা জটিল এথেকেই তার অনুমান করা যায়।

দেশের অনেক মানুষ দেশের বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি নানান কাজে জড়িত থাকে। তাদের আয় হিসাবে নিতে হলে তা আরও বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। সব মিলিয়ে জাতীয় আয় পরিমাপ বাস্তবে অত্যন্ত কষ্টকর। জাতীয় আয় পরিমাপের প্রধান সমস্যাসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
জাতীয় আয় পরিমাপের সমস্যাসমূহ
১. দ্বৈত গণনার সমস্যা (Problem of double counting): একটি নির্দিষ্ট অর্থ বছরে একই উৎপাদনের মূল্যকে একাধিক বার জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করাকে দ্বৈত গণনা বলে। আর দ্বৈত গণনার সমস্যা বলতে জাতীয় উৎপাদন হিসাবের ক্ষেত্রে একই উৎপাদন একাধিকবার হিসাবভুক্ত হওয়ার ফলে জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় আয় অনেক বেড়ে যাওয়াকে বুঝায়।

ফলে জাতীয় আয়ের সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। কৃষক গম উৎপাদন করলো। ফ্লাওয়ার মিল তা থেকে আটা তৈরি করলো। বেকারিগুলো তাথেকে রুটি বা পাউরুটি তৈরি করলো।

এখন প্রত্যেকের উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্য যদি হিসাবে নেয়া হয় তবে দেখা যাবে একই পণ্য আরও দুইবার মূল্যায়িত হয়েছে। এই সমস্যা জাতীয় আয় গণনার একটা মুখ্য অন্তরায়। এথেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চূড়ান্ত পণ্যকে হিসাবে ধরার চেষ্টা করা হয়। তবে তাও কষ্টসাধ্য।

২. সঠিক তথ্যের অভাব (Lack of proper information): একটা দেশে কতটা ধান উৎপাদন হলো এই তথ্য বের করা একটা জটিল কাজ। সরকার দ্বৈবচয়িত গণনা পদ্ধতি (Random sampling method) ব্যবহার করে দেখলো প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ধানের ফলন কত হয়েছে। এই যে ঠিক করা হলো তা কতটা নির্ভরযোগ্য এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। কত জমিতে ধান চাষ হয়েছে কৃষি বিভাগ তার একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছে। তার উপরই বা কতটা নির্ভর করা যায়। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎপাদনের হিসাব করা, মূল্য সংযোজন, মজুরি, খাজনা ইত্যাদি হিসাবভুক্ত হওয়া অত্যন্ত জটিল বিষয়। বিভিন্ন সরকারি বিভাগগুলো তাদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য হিসাব ছাড়াই মিথ্যা তথ্য তৈরি করে জাতীয় আয় পরিমাপকে আরও জটিল করে তোলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সমস্যা আরও প্রকট। তাই সঠিক তথ্যের অভাবে জাতীয় আয় পরিমাপ বাধাগ্রস্ত হয়।

৩. আর্থিক মূল্য নিরূপণে সমস্যা (Problem in measuring financial value): জাতীয় আয় টাকার অংকে প্রকাশ করা হয়। এই টাকার অংক নির্ধারণ সর্বক্ষেত্রে সম্ভব নয়। মা সন্তান-সন্ততি লালন পালন করেন। রান্না-বান্নাসহ রাতদিন পরিশ্রম করেন। এটার যেহেতু আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা হয় না তাই জাতীয় আয় নিরূপণে তা বাদ পড়ে যায়। এতে প্রকৃত জাতীয় আয় সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না। এছাড়া মূল্যস্তর সবসময় ওঠা-নামা করে। ফলে যে ধান মৌসুমে ৬০০ টাকা মণ থাকে, তা কখনও বেড়ে ৯০০ বা ১,০০০ টাকাও হয়ে যায়। এভাবে প্রতিটা জিনিষের দাম পরিবর্তন হয়। ফলে আর্থিক মূল্য নিরূপণের বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়।

৪. আন্তর্জাতিক বিষয়াদিজনিত সমস্যা (Problem related with international issues): আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নানান বিষয়ও জাতীয় আয় পরিমাপে বাধার সৃষ্টি করে। মোট জাতীয় উৎপাদন হিসাবের ক্ষেত্রে বিদেশি যারা দেশে বসবাস করে তাদের উৎপাদন হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয় এবং বিদেশে কর্মরত দেশীয় জনশক্তির উৎপাদন হিসাবে নেয়া হয়। যে সকল জনশক্তি বিদেশে কর্মরত থাকে বা বিভিন্ন ব্যবসা- বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকে তাদের আয় হিসাবভুক্ত করা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এজন্য বিদেশি জনশক্তির পাঠানো রেমিটেন্সকে হিসাবে ধরার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া রপ্তানি আয়কে জাতীয় আয়ের সাথে না ধরার কারণেও এক্ষেত্রে কিছু আয় বাদ পড়ে যায়। ফলে প্রকৃত জাতীয় আয় নিরূপণ করা যায় না।

৫. অবচয় ও কর সংক্রান্ত সমস্যা (Problem related with depreciation and tax): অবচয় এবং কর হিসাবভুক্তকরণও জাতীয় আয় পরিমাপের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। মূলধনী যন্ত্রপাতির অবচয় নির্ধারণের সর্বজন গ্রাহ্য কোনো পদ্ধতি নেই। কার্যত একেক ধরনের মূলধনী যন্ত্রপাতিতে একেক হারে অবচয় নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে সরকার যে হিসাব করে তা একটা অনুমাননির্ভর পদ্ধতি হিসেবেই বিবেচিত হয়। এছাড়া দেশে মূলধনী সম্পত্তি কত রয়েছে এটা নিরূপণ করাও কষ্টসাধ্য বিষয়। এছাড়া জাতীয় আয় নির্ধারণে পরোক্ষ করকে হিসাবে আনা হয়। কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও সঠিক কর নির্ধারণে বাধার সৃষ্টি করে। অনেক সময় তথ্য গোপনের ফলে প্রকৃত উৎপাদনের তথ্যই পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় জাতীয় আয় নিরূপণ কখনই যথার্থ হয় না।

৬. হস্তান্তর পাওনা নির্ধারণে সমস্যা (Problem to calculate transferable income): জাতীয় আয় পরিমাপের সময় হস্তান্তর পাওনাসমূহ বাদ দিতে হয়। সমাজের অনেক লোক আছে যারা কোনোরূপ উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করেও কিছুনা কিছু আয় করে যা হস্তান্তর পাওনা হিসেবে গণ্য হয়। যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, উদ্বাস্তু কর্তৃক গৃহীত সাহায্য, বেকার ভাতাসহ নানান ধরনের ভাতা। কিন্তু এ সকল হস্তান্তর পাওনা হিসাব করা অত্যন্ত জটিল হওয়ায় জাতীয় আয়কে সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।

৭. বিশেষীকরণের অভাব (Lack of specialization): অনুন্নত দেশসমূহে জাতীয় আয় পরিমাপে বিশেষীকরণের অভাব লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ একই লোক একই পেশায় নিয়োজিত না থেকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকে। যেমন- একই শ্রমিক কখনও কখনও কৃষি কাজ করে, কখনও কখনও রিকসা চালায় আবার কখনও কখনও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবেও কাজ করে। এরূপ অবস্থায় বিশেষীকরণে সমস্যা হয়। তাই জাতীয় আয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্র হতে কি পরিমাণ আয় হলো তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। না।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় আয় পরিমাপ করা যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতীয় আয় পরিমাপের গুরুত্বকে বিবেচনা করেই বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার জাতীয় আয় পরিমাপ করে থাকে। তবে এরূপ আয় পরিমাপ করা অত সহজ নয়। নানান ধরনের সমস্যা এর সাথে জড়িত। তবে জাতীয় আয় পরিমাপের সাথে জড়িত এ সমস্যাগুলোর কোনোটি তাত্ত্বিক আবার কোনোটি নিরেট বাস্তবতা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url