জাহাজী দলিল পত্র Shipping Documents
জাহাজে পণ্য-দ্রব্য প্রেরণের সংবাদ প্রেরণের পর-পরই রপ্তানিকারক রপ্তানিকৃত পণ্যের যে সকল দলিলপত্র তৈরি করে ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারকের নিকট প্রেরণ করে, তাকে জাহাজী দলিল।
এই দলিলপত্র আমদানিকারকের আমদানিকৃত পণ্যের মালিকানা স্বত্বের প্রমাণ। এই দলিলপত্র বন্দর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজ কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করে আমদানিকারকে পণ্য খালাস করতে হয়। জাহাজ দলিলগুলোকে আমরা এভাগে ভাগ করতে পারি।
জাহাজী দলিল পত্র কি কি?
১. চালানি রসিদ বা বহনপত্র (Bill of eading)
২. বীমাপত্র (Insurance policy)
৩. বিনিময় বিল (Bill of Inroice)
৪. চালান (Invoice)
৫. বাণিজ্যদূতের চালান (Consular invoice)
৬. প্রভব লেখ বা উৎপত্তির সনদ (Certificate of origin)
নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
চালানি রসিদ বা বহন পত্র (Bill of lading)
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো চালানি রসিদ। জাহাজে পণ্য বোঝাই করার পর ইহার ক্যাপ্টেনের পণ্য বোঝাই সংক্রান্ত কাঁচা রসিদ (Mate receipt) এর বিনিময়ে জাহাজ কর্তৃপক্ষ যে রসিদ প্রদান করে তাকে চালানি রসিদ বলে।
এই রসিদে বোঝাইকৃত পণ্যের বিবরণ এবং জাহাজ ভাড়া সংক্রান্ত নিম্নরূপ তথ্যাদি থাকেঃ পণ্য-দ্রব্যের পূর্ণ বিবরণ, ট্রেড মার্ক, পণ্যের ওজন ও পরিমাণ, জাহাজ ও জাহাজ কোম্পানির নাম, জাহাজ ভাড়ার পরিমাণ, আমদানিকারকের নামও ঠিকানা, রপ্তানিকারকের নাম ও ঠিকানা, জাহাজ ছাড়া ও পৌঁছানোর তারিখ, প্রেরকের ও প্রাপকের বন্দরের নাম ইত্যাদি।
এই দলিল আমদানিকারককে পণ্যের মালিকানা স্বত্ব প্রদান করে। সাধারণত এই রসিদ তিন কপি রপ্তানিকারক তৈরি করে এবং প্রতিটিতে জাহাজ কর্তৃপক্ষ স্বাক্ষর ও সীল প্রদান করে থাকে। রপ্তানিকারক জাহাজ ভাড়া প্রদান করলে 'Freight Paid' এবং ভাড়া প্রদান না করলে 'Freight Forward' সীলযুক্ত করে দেয়।
চালানি রসিদের তিন কপির এক কপি রপ্তানিকারক নিজের কাছে রেখে দেয়, এক কপি ডাক যোগে এবং এক কপি ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারকের নিকট প্রেরণ করে। চালানি রসিদের মাধ্যমে আমদানিকারক জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে। এই রসিদ হস্তান্তরযোগ্য। আমদানিকারক চালানি রসিদের পিচনে স্বাক্ষর করে য কোন লোকের নিকট তা হস্তান্তর করতে পারে।
বীমাপত্র |Insurance Policy
পণ্য আমদানি-রপ্তানি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সমুদ্র পথে নিরাপদে আমদানিকারকে হাতে পণ্য পৌঁছানোর জন্য রপ্তানিকারক বীমা কোম্পানির সাথে যে চুক্তি সম্পাদন করে, তাকে বীমাপত্র বলে। এর মাধ্যমে সমুদ্র পথের সকল বিপদের ঝুঁকি বীমা কোম্পানি বহন কের থাকে।
বীমাপত্র গ্রহণের প্রাথমিক ব্যয় ও প্রিমিয়াম রপ্তানিকারক প্রদান করলেও পরবর্তীতে আমদানিকারক তা পরিশোধ করে থাকে। বীমাকৃত পণ্যের কোনরূপ ক্ষতি হলে বীমা কোম্পানি চুক্তির শর্ত মোতাবেক তা পরিশোধ করে থাকে। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারীকে বাড়তি ঝুঁকি বহন করতে বা কোন রূপ চিন্তা করতে হয় না।
বিনিময় বিল | Bill of Exchange
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের দেনা-পাওনা মিটানোর ক্ষেত্রে বিনিময় বিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দলিলের মাধ্যমে রপ্তানিকারক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, নির্দিষ্ট সময়ে বা চাহিবামাত্র প্রাপককে অথবা তার নির্দেশ মতো অন্য কোন ব্যক্তিকে পরিশোধের জন্য আমদানিকারককে নির্দেশ প্রদান করে তাকে বিনিময় বিল বলে।
জাহাজে পণ্য বোঝাই করার পর রপ্তানিকারক চালানি রসিদ, বীমাপত্র ইত্যাদির সাথে বিনিময় বিলও আমদানি কারকের নিকট ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে।
ব্যাংক বিনিময় বিল আমদানিকারকের নিকট উপস্থাপন করে ইহার অর্থ বা স্বীকৃতি দাবি করে। স্বীকৃতি পাবার পর তা রপ্তানিকারকের নিকট পাঠিয়ে দেয়। রপ্তানিকারক ইচ্ছে করলে মেয়াদপূর্ণতার পূর্বে বা পরে বিনিময় বিল ব্যাংক থেকে ভাংগিয়ে নিতে পারে।
চালান | Invoice
জাহাজে প্রেরণের পূর্বেই পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ ও মূল্য উল্লেখ করে আমদানিকারকের নিকট রপ্তানিকারক যে বিবরণী প্রেরণ করে, তাকে চালান বলে। চালানে পণ্যের পূর্ণ বর্ণনা, পরিমাণ, মূল্য, প্যাকিং সংখ্যা ও ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, বীমা প্রিমিয়াম ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
চালান থেকে আমদানিকারকের পণ্য সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা জন্মে এবং পণ্য প্রাপ্তির পর সে চালানের সাতে তা মিলিয়ে দেখে। চালানোর একটি কপি নিজের কাছে, এক কপি ব্যাংকের মাধ্যমে এবং অপর কপিটিও ডাকযোগে আমদানিকারকের নিকট পাঠিয়ে দেয়।
বাণিজ্যদূতের চালান | Consular Invoice
দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক দেশ অন্য কোন তার বাণিজ্যিক দূত নিয়োগ দিয়ে তাকে। তার কাজ হলো আমদানিযোগ্য পণ্যে আমার জন্য ছাড়পত্র দেয়া। রপ্তানিকারক তার পণ্যের তিন কপি চালান তৈরি করে আমদানিকারকের দেশের বাণিজ্য দূতের নিকট প্রেরণ করে। আমদানির তালিকাভুক্ত পণ্য হলে বাণিজ্য দূত তা আমদানি যোগ্য বলে প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করে। ইহাকে বাণিজ্যদূতের চালান বলে।
এই চালানের তিনটি কপি করা হয। একটি কপি বাণিজ্য দূত নিজের কাছে রাখে। এক কপি রপ্তানিকারককে ফেরৎ দেয় এবং এক কপি নিজ দেশের আমদানি বন্দরে শুল্ক কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করে। রপ্তানিকারক তার কপিটি অন্যান্য দলিলের সাথে ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারকের নিকট প্রেরণ করে।
প্রভব লেখ বা উৎপত্তির সনদ | Certificate of Origin
এটি একটি বিশেষ ঘোষণা পত্র। এর মাধ্যমে রপ্তানিকারক রপ্তানিকৃেত পণ্য কোন দেশের তৈরি তা ঘোষণা করে। প্রভব লেখ স্থানীয় বণিক সভা কর্তৃক সত্যায়িত হতে হয়। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, পণ্যটি আমদানিকারকের দেশে নিষিদ্ধ নয়।
অনেক সময় বিভিন্ন দেশের জন্য পৃথক পৃথক শুল্ক ধার্য করা হয়। প্রভব লেখ থেকে উৎপত্তির দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শুল্ক কর্তৃপক্ষ পণ্যের উপর সহজেই শুল্ক ধার্য করতে পারে।